স্বকৃত নোমান : মাদকাসক্তি ও মাদকের সহজলভ্যতার কারণগুলো চিহ্নিত না করে, ছিদ্রগুলো বন্ধ না করে, বড় বড় রাঘব-বোয়ালদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে, চুনোপুটি মাদক বিক্রেতাদের নির্বিচারে হত্যা করে মাদক-বিরোধী অভিযান সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। একটি অনলাইন নিউজপোর্টালের সংবাদ অনুযায়ী, গত ক’দিনে আটজন মাদক চোরাকারবারীকে তথাকথিত ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়েছে। ভিক্টর হুগো বলেছিলেন, ‘একজন মানুষকে গিলোটিনের নিচে ফেলে দেওয়ার অর্থ শুধু এই নয় যে শুধু তাকেই হত্যা করা হলো। তার সঙ্গে হত্যা করা হলো তার পরিবারকেও।’ যেসব মাদক বিক্রেতাকে হত্যা করা হচ্ছে, শুধু তাকেই হত্যা করা হচ্ছে না, নিমেষেই ধুলিস্যাৎ করে দেওয়া হচ্ছে একটি পরিবারকেও। এটা কোনো সমাধানের রাস্তা হতে পারে না। হত্যার মধ্যদিয়ে কোনো কিছুকে নির্মূল করা যায় না, বরং তা আরও উসকে ওঠে। সমাজে প্রতিশোধপরায়ণতা বাড়ে।
খুব তো বুক ফুলিয়ে দাবি করা হয় ৯০ পার্সেন্ট মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশ। তাই যদি হয়, মাদকের বিরুদ্ধে ধর্মের ভূমিকা কোথায়? ধর্ম কেন পারছে না প্রজন্মকে মাদকাসক্তি থেকে দূরে রাখতে? কারণ কিছুই না। ধর্মের আদর্শ যদি কিছু থেকে থাকে তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে চলানো হচ্ছে অধর্ম, চলানো হচ্ছে ধর্মব্যবসা। যার ফলে ধর্মগ্রন্থ কোরআনের পাতা কেটে তার ভেতরে ইয়াবা ঢুকিয়ে পাচার করার ঘটনাও ঘটতে দেখা যাচ্ছে। ধর্মনেতারা মসজিদে মাদকের বিরুদ্ধে বলবেন না, বলবেন নাস্তিকদের বিরুদ্ধে, অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে। তাকেই তারা ধর্ম মনে করে। সুতরাং তাদের কাছ থেকে কিছু আশা করে লাভ নেই।
একটা সময় গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় সংস্কৃতির চর্চা হতো, নাটক-সংগীতের চর্চা হতো, স্কুল-কলেজে ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন। তার সবই এখন বন্ধ করা হয়েছে। ছাত্র রাজনীতিও চলে গেছে অস্ত্রবাজ আর লুটেরাদের দখলে। পাঠাগারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। একজন তরুণ যে প্রকৃত মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখবে, কোথাও গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে, তার কোনো জায়গা নেই। স্বপ্ন দেখার, নিশ্বাস ফেলার সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে একটি সমাজ চলতে পারে না। কতজনকে ক্রসফায়ার দেবেন? সাংবাদিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, সতের কোটি মানুষের জন্য জনপ্রতি পাঁচটি করে ইয়াব ঢুকছে দেশে? এই বিপুল সংখ্যক ইয়াবা পাচারের নেপথ্যে কত হাজার চোরাকারবারী? সবাইকে ক্রসফায়ারে দেওয়া যাবে? মনে হয় না।
ইয়াব ও ফেনসিডিল আসছে মূলত মিয়ানমার ও ভারত থেকে। আমাদের সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীদের কাজ কী? সীমান্ত পাহারা মানে মিয়ানমার বা ভারত ভূখ- জবর-দখল করে নিয়ে যাবে এটা ঠেকানোই শুধু তাদের কাজ? নাকি মাদক যাতে দেশে ঢুকতে না পারে সেই প্রচেষ্টা চালানোও তাদের কাজের মধ্যে পড়ে? যদি দ্বিতীয়ওটাও কাজ হয়ে থাকে, তাহলে দেশে এত মাদক ঢুকছে কীভাবে? নিশ্চয়ই কোনো-না কোনোভাবে তাদের আশ্রয়-প্রশয় রয়েছে? নাকি তারা সামাল দিতে পারছেন না? সামাল দিতে না পারলে কেন সীমান্ত সুরক্ষার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?
তথাকথিত ক্রসফায়ার কোনো সমাধানের পথ নয়। সভ্য দেশে এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চলতে পারে না। সরকারকে বিকল্প ভাবতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক