নিউজ ডেস্ক: দেশের ২২ জন কর্মী বিদেশ থেকে সারা বছর যে আয় পাঠান তা বিদেশের একজন কর্মীই নিয়ে যান। দেশের একজন অভিবাসী কর্মী বছরে দেশে পাঠান ১৩শ থেকে ১৪শ ডলার। কিন্তু বিপরীতে দেশে কর্মরত বিদেশি একজন নাগরিক বেতন, ভাতা বা সম্মানী হিসেবে নিয়ে যান ২৫ থেকে ৩০ হাজার ডলার। দেশের ভুল শিক্ষা পদ্ধতি, প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশমুখী মানসিকতা, প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকের অভাব এবং কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানির চুক্তির কারণে বিশাল অঙ্কের এ অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া যায়। এজন্য পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা প্রদান, ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে দক্ষ লোক তৈরিতে পদক্ষেপ গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশীয় লোকবল বাড়ানোর কথা বলছেন বিশ্লেষকরা।
প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত বিদেশিরা বছরে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার বা প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। বিদেশিদের সংখ্যা বলা হচ্ছে ২ লাখ। সে হিসেবে একজন বিদেশি নাগরিক বছরে দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে ৩০ হাজার ডলার।
প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের ওই তথ্যে দেখা যায়, বিদেশে বাংলাদেশের এক কোটি ১০ লাখ লোক কর্মরত রয়েছেন তাদের পাঠানো মোট রেমিটেন্সের পরিমাণ ১৫শ কোটি ডলার। সে হিসাবে একজন বাংলাদেশি প্রবাসী দেশে পাঠান ১ হাজার ৩৬৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ ২২ জন বাংলাদেশি যে রেমিটেন্স পাঠান বাংলাদেশে কর্মরত একজন বিদেশি নাগরিকই তার সমান অর্থ পান। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি খোদ এসব বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন।
সম্প্রতি প্রকাশিত পিউ রিসার্চ সেন্টারের প্রকাশিত গবেষণার তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ২০১ কোটি ৩০ লাখ ডলার রেমিটেন্স হিসেবে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়েছে বিদেশি নাগরিকরা। এ সময় দেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ছিল ৮৫ হাজার। তাদের হিসেবে একজন বিদেশি নাগরিক বছরে ২৩ হাজার ৫২৯ ডলার নিজ নিজ দেশে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একই সময়ের রেমিটেন্স আয় বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আমাদের একজন প্রবাসী সারা বছরে দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়েছে ১ হাজার ২৭৮ ডলার। ২০১৬ সালে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল ১ কোটি জন। ওই বছর মোট রেমিটেন্স এসেছে ১ হাজার ২৭৮ কোটি ডলার। সে হিসেবে একজন বিদেশি নাগরিক যা নিয়ে যান তা আমাদের ১৮ জন প্রবাসীর আয়ের সমান। গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি নাগরিক কাজ করেন তৈরি পোশাক খাতে। এবং সবচেয়ে বেশি কাজ করেন ভারতের নাগরিক। তাদের সংখ্যা ৩৫ হাজারের উপরে।
বাংলাদেশে কত বিদেশি নাগরিক কাজ করেন, তার একটি হিসাব ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তার দেয়া হিসাব অনুযায়ী, এ দেশে ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি নাগরিক কাজ করেন, তাদের অর্ধেকই ভারতীয়। ভারতীয়দের সংখ্যা ৩৫ হাজার ৩৮৬ জন এবং চীনা ১৩ হাজার ২৬৮ জন। এরপর রয়েছে জাপান হাজার ৯৩ জন। এছাড়া কোরিয়ার ৪ হাজার ৯৩ জন, মালয়েশিয়ার ৩ হাজার ৩৯৫ জন ও শ্রীলঙ্কার ৩ হাজার ৭৭ জন নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন। থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সিঙ্গাপুর ও তুরস্কের নাগরিকরাও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত।
এতো বিশাল অঙ্কের অর্থ ও বিদেশি নাগরিক নিয়োগের জন্য দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেন ডিসিসিআই সভাপতি আবুল কাশেম খান। তিনি বলেন, গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, বিদ্যুৎ, ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, অবকাঠামো এবং পরামর্শক সেবা খাতে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে দেশীয় জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে। বিদেশি পেশাজীবী নিয়োগ কমাতে এসব খাতের উদ্যোক্তারা উদ্যোগ নিতে হবে। জার্মানির মতো দেশগুলো তাদের শিল্পের কী চাহিদা, সে অনুযায়ী জনশক্তি তৈরি করে। বাংলাদেশেও সেটা দরকার।
একই অভিযোগ করেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সদস্য ও এসিআই গ্রুপের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলা। তিনি বলেন, দেশের উচ্চ শিক্ষিতদের ইংরেজি জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তারা হাতে-কলমেও কিছু শেখেন না। ওয়েল্ডিং সুপারভাইজার পদে আগ্রহী একজন প্রকৌশলী জানেন না কীভাবে ওয়েল্ডিং করতে হয়। তাকে হাতে-কলমে এ শিক্ষা দেয়া হয়নি।
এজন্য শিক্ষা ব্যবস্থার পদ্ধতিকে দায়ী করেন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ফজলুল হক। তিনি বলেন, দক্ষ লোকের অভাবের মূল কারণ দেশে কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষতার ঘাটতি। শিল্পের যে চাহিদা, সে অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ানো হয় না। তিনি বলেন, এ দেশের তরুণরা সাধারণ শিক্ষার পেছনে দৌড়ায়। কিন্তু বেসরকারি খাতে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের চাহিদা কম। ফলে উচ্চশিক্ষা লাভ করেও তরুণরা চাকরি পাচ্ছে না, হতাশা বাড়ছে।
সম্প্রতি ঢাকা চেম্বার আয়োজিত এক সেমিনারে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে দক্ষতা উন্নয়ন না হওয়ায় বিদেশি ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন ও দক্ষ জনবল নিয়োগে অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। বিদেশে যেসব বাংলাদেশি দক্ষ ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের জনবল রয়েছে, তাদের দেশে আসার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে কর ছাড় ও প্রণোদনা সহযোগিতা ও দেশেই দক্ষতা উন্নয়নে আরও মনোযোগী হতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কার্যক্রম চালানোর আহ্বান জানানো হয়। এ সময় বক্তারা বলেন, অনেক বিদেশি পেশাজীবী বাংলাদেশে রয়েছে। তাদের দক্ষতার সঙ্গে আমাদের ফারাক চিহ্নিত করে এর ভিত্তিতে দেশীয় জনশক্তিকে দক্ষতা উন্নয়নে মনোযোগী হওয়া দরকার। একই সঙ্গে কোন কর্মীর দক্ষতা উন্নয়নে প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করার পর ওই কর্মী অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ায় ইস্যুটিও উঠে আসে। একাধিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী বলেন, কর্মীর দক্ষতা উন্নয়নে আমরা বিনিয়োগ করি কিন্তু অন্যত্র চলে গেলে তার সুফল পাই না। এক্ষেত্রে নীতিমালা থাকা দরকার।
জানা যায়, বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের কাজের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও এনজিও বিষয়ক ব্যুরো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই অনুমতি নেয়া হয় বিডার কাছ থেকে। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ১৭১ জন বিদেশি নাগরিককে কাজের অনুমতি দিয়েছে। অন্যদিকে নবায়ন করা হয়েছে ৪ হাজার ১১৩ জনের। বেপজা জানিয়েছে, এখন রপ্তানি প্রকিয়াকরণ অঞ্চলগুলোতে আড়াই হাজারের মতো বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। বিদেশিদের বেতন বাংলাদেশিদের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি। সূত্র: সংবাদ