বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার, এর মধ্যে সুন্দরবন ১২৫ কিলোমিটার, নদীর মোহনা ও ছোট বড় দ্বীপমালা ২৭৫ কিলোমিটার, সমতল ও সমুদ্র সৈকত ৩১০ কিলোমিটার। টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গলÑ কালিন্দী পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত বাংলাদেশের উপকূলেই দেশের প্রধান দুটি সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা, বিশ্বের সেরা গহীন গরান বন সুন্দরবন এবং বিশ্বের অন্যতম অখ-িত (আনব্রোকেন) সমুদ্র সৈকত বা বেলা ভূমি কক্সবাজার অবস্থিত। দেশের শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ যেমন এই উপকূল অঞ্চলে বসবাস করে তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ অবদানও এই অঞ্চলেরই।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চাইতে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চল, এর অবকাঠামো এবং বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানান দৈব-দুর্বিপাক, বৈষম্য, অবহেলা আর অমনোযোগিতার শিকার। সাম্প্রতিক কালের সর্বশেষ সর্বনাশের সন্দেশ হচ্ছে সুন্দরবনের গা ঘেষে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনসহ সাম্প্রতিককালে মিডিয়া মারফত জানা মতে, সুন্দরবনের গা ঘেষে কিংবা কিছুটা দূরে পরিবেশ দূষণকারী শিল্পকলকারখানার অনুমোদন দেওয়ার যেন মহাউৎসব চলছে। যতই বলা হোক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প স্থাপনের সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না, যারা যেভাবে বলছেন, তারা তো যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন না, প্রকৃতির সেই সর্বনাশ ভোগ করতে। আন্তর্জাতিক নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে ভাটির দেশ ও জাতির সামাজিক অর্থনীতির হাট ঘাট কিভাবে তিলে তিলে পয়মাল করা হচ্ছে তা দেখার পরও অন্ধত্বের অভিনয় তো সুন্দরবনের সাথে অসুন্দর ব্যবহারের বিমূর্ত প্রকাশ।
ভারত সাগরের উত্তর পূর্বভাগে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের পশ্চিম উপকূলে ২০.২৫ ও ২৩.২ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৩৫ ও ৯২.২৪ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে বঙ্গোপসাগরের ভৌগলিক অবস্থানই এমন যে কথায় কথায় তার মেজাজ বিগড়ে যায়, মৌসুমী সঞ্চরণশীল মেঘের অবারিত অভিসার যেমন তাকে নাচায় তেমনি জাতীয় কবি নজরুলের ক্ষুধিত বন্ধু সে তৃষিত জলধি যার চিত্ত শত ক্ষুধার উদ্রেক করে উপকূল বাসিদের জীবন তছনছ করতে তার আনন্দ যেন বেশি। বলা নেই, কওয়া নেই সমুদ্র প্রায় উত্তাল থাকে। তার মন পবনের ঠিকানা বাংলাদেশের আবহাওয়া দপ্তর ঠাই পায় না। তার এই প্রায়শ পাগলামী সুন্দরবন বরাবরই মাথায় পেতে নিয়ে সাতক্ষীরা খুলনা বাগেরহাট পিরোজপুর বরিশাল বরগুনা পটুয়াখালীকে শেলটার দিয়ে চলেছে। ১৭৯৭ থেকে শুরু করে ২০০৯ সালে আইলা পর্যন্ত সময়ের শুমার পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে মোট ৪৭৮ বার মাঝারি ও মোটা দাগের জলোচ্ছ্বাস, গোর্কি, হারিকেন, সিডর, নার্গিসেরা বাংলাদেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।
১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ঙ্করী ঘুর্নিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯টি, এসেছে গড়ে ৫-১০ বছর পর পর, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ এর বিগত ৪৬ বছরে ১৫৫টি ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস ঘটেছে ঘন ঘন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সর্বশেষ সিডর আর আইলার আঘাতে স্বয়ং সুন্দরবনও পর্যুদস্ত হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল প্রকৃতির বিরূপ আচরণের প্রথম ও প্রত্যক্ষ শিকার সব সময়েই। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতির সুরত হাল রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে এটা প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে জাতীয় অর্থনীতির আন্তসলিলা শক্তির উদ্বোধন যার হাতে সেই সুন্দরবন সবচাইতে বেদনায় বিবর্ণ।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো অর্থনীতির অনেক প্রবণতার সূচক সন্ধানে কালাতিপাত করে কিন্তু উপকূলীয় জেলা নিচয়ের আর্থ-সামাজিক চালচিত্রের, খানা পুরী থেকে শুরু করে ভূমি বন্টন ব্যবস্থা, চাষাবাদের হাল হকিকত, প্রাণী সম্পদের সালতামামী অনেক কিছুরই বাস্তবতার ব্যাখ্যা তাদের কাছে নেই। উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতি যেন শুধু দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের মাথাব্যাথা সূত্রে সমুপস্থিত শুধু আকালের দিনে নাকালের মোহনায় এবং একমাত্র মিডিয়ায়।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান