তারেক : প্রশ্নফাঁস রোধে আগামী বছর থেকে নতুন পদ্ধতিতে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়ার যে উদ্যোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হচ্ছে তাকে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো বলে মনে করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একটা জলজ্যান্ত প্রশাসনিক ব্যর্থতা ঢাকার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে বর্তমান এ উদ্ভট ‘এক্সপেরিমেন্ট’-এর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে নতুন করে বিপর্য ঘটবে শিক্ষাব্যবস্থায়।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, অপেশাদার লোকজনের বুদ্ধি নিয়ে সরকার এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অত্যুৎসাহী কিছু আমলা এর পেছনে ভূমিকা রাখছে বলেও মনে করছেন তারা। অনেকে বলছেন, প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় অস্বস্তিতে পড়ে সরকার তড়িঘড়ি করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে পরীক্ষাপদ্ধতি ও প্রশ্নপদ্ধতি নিয়ে একটা ভজকট পাকিয়ে ফেলছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এসব করে নির্বাচন পর্যন্ত হয়তো পার পেয়ে যাবে। কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার তা হবে শিক্ষার্থীদের; যাদের মেধার ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে আগামীর বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবিলম্বে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসা উচিত। এজন্য প্রয়োজনে পেশাদার, যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষাবিদদের পরামর্শ নিক সরকার।
গত মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় আগামী বছর থেকে নতুন পদ্ধতিতে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যে নতুন পদ্ধতির কথা বলছেন, তাতে কয়েকশ প্রশ্ন নিয়ে একটি ‘প্রশ্নব্যাংক’ করা হবে। একইসঙ্গে এমসিকিউ (বহু নির্বাচনী প্রশ্ন) তুলে দেওয়ার পক্ষে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এমসিকিউ তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। তার এ মতকেই নির্দেশ হিসেবে দেখছে মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়েও ওই সভায় এসএসসিসহ পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের সম্ভাব্য ছয়টি ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করেন। কোত্থেকে কীভাবে কারা প্রশ্নফাঁস করছে এ ব্যাপারে আলোচনা করলেও ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য উঠে আসেনি সভায়।
এদিকে নতুন প্রশ্নপদ্ধতির ব্যাপারে শিক্ষাবিদ ড. সিদ্দিকুর রহমান খোলা কাগজকে বলেন, পরীক্ষা নেওয়া, প্রশ্নপত্র তৈরি, ছাপা ও বিতরণ- এ পুরো প্রক্রিয়াটি প্রশাসনিক কাজ। এখানে প্রশ্নের কোনো দোষ নেই যে প্রশ্নপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এমনকি কারিকুলামেরও কোনো দোষ আমি দেখি না। মূলত পুরো শিক্ষা প্রশাসন প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। তারাই এখন উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্টরা এটা স্বীকার করতে চাইছেন না। শিক্ষামন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের লোকজন সব সাফল্যের কৃতিত্ব নেবেন কিন্তু প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায় নেবেন না, এটা তো হয় না।
তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো যে ভয়াবহ প্রক্রিয়া চলছে, তা ঠেকাতে এর গোড়ায় যেতে হবে। আর গোড়ায় গেলেই এর পেছনে বিশাল এক সিন্ডিকেট ধরা পড়বে। সেখানে সরকারবিদ্বেষী বা বিরোধী প্রশাসনিক আমলা থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ের দুর্বৃত্তদের পাওয়া যাবে। কিন্তু সরকার সে বিষয়ে উদ্যোগী না হয়ে প্রশ্নপদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে জগাখিচুড়ি কেন পাকাচ্ছে, সেটা আমার বোধগম্য নয়।
ড. সিদ্দিক বলেন, একটা বিষয় ভাবাটা খুব জরুরি। সৃজনশীল পদ্ধতিতে আমরা নৈর্ব্যক্তিক (অবজেকটিভ), বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) এবং রচনামূলক প্রতিটি স্তরই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ এসব বহুস্তরের প্রশ্নপদ্ধতির মধ্য দিয়ে গোটা সিলেবাসকে আমরা কাভার করি। আগামী বছর থেকে যদি অবজেকটিভ বা এমসিকিউ তুলে দিয়ে কেবল কিছু রচনামূলক প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয় তখন তো শিক্ষার্থীর জ্ঞান যাচাই খণ্ডিত হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীরা খণ্ডিত এবং অসম্পূর্ণ বা সীমাবদ্ধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের প্রবণতায় পর্যবসিত হবে। এটা কোনোভাবেই উচিত কাজ হবে না। উপরন্তু নতুন আরেকটা দুর্বলতা তৈরি হবে শিক্ষাক্ষেত্রে।
সরকার অপেশাদার, অদক্ষ ও অযোগ্য লোকদের দিয়ে শিক্ষা প্রশাসন চালায় মন্তব্য করে ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া দরকার তাকে সে দায়িত্ব দেওয়া হয় না। উপরন্তু যোগ্যদের সরিয়ে রাখা হয়। সামনে যে পরীক্ষাপদ্ধতি বা প্রশ্নপদ্ধতি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয় নিয়েছে, আমার বিশ্বাস অপেশাদার মানুষের কাছ থেকে এ পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষা বিষয়ে যাদের ন্যূনতম জ্ঞান আছে তাদের তো সরকারের এ সিদ্ধান্তে শঙ্কিত হওয়ার কথা।
সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এ সরকারের বহু সাফল্য আছে। কিন্তু প্রশ্নফাঁসের ঘটনা সব সাফল্যকে ম্লান করে দিয়েছে। প্রশাসনিক কাজগুলোকে ব্যর্থ করার জন্য কারা কলকাঠি নাড়ছে তা বের করতে হবে। আমরা আগে কখনো এ মাত্রায় প্রশ্নফাঁস হতে দেখিনি। নির্বাচনী বছরে এসে কেন এটা দেখতে হচ্ছে। সরকারের এ ব্যাপারে সজাগ হওয়া উচিত ছিল।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠপুস্তক বোর্ডের এক কর্মকতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খোলা কাগজকে বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষার্থীর পূর্ণ যোগ্যতা যাচাইয়ের মাপকাঠি। সেখানে যদি এমসিকিউ তুলে দেওয়া হয় তাহলে শিক্ষার্থীর দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই অপূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ রয়ে যাবে। নির্ধারিত প্রশ্নের বাইরে শিক্ষার্থীরা আর কিছু পড়বে না। ফলে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা যাচাই হবে খণ্ডিত। এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন একটা বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
তিনিও প্রশ্নফাঁসের ঘটনাকে প্রশাসনিক ব্যর্থতা বলেই মনে করেন। তিনি বলেন, আমলাতন্ত্রের ভেতরে একটা শক্তি সব সময় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারাই পুরো শিক্ষা প্রশসানকে জিম্মি করে সরকারকে বিপদে ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যেই আমাদের কাছে সে ধরনের অনেক প্রামাণ্য তথ্য এসেছে।
তিনি বলেন, প্রযুক্তির কারণে প্রশ্নফাঁস হচ্ছে বলে আমি মনে করি না। প্রযুক্তি ব্যবহার করে জামায়াত-বিএনপির একটি চক্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর নামে ভুয়া আইডি খুলে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হচ্ছে, বাঁশের কেল্লা নামের শিবির পরিচালিত আইডি থেকে প্রশ্ন ফাঁস করে সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। ফলে বুঝতে হবে এসব ঘটনার পেছনে নোংরা রাজনীতিও বিদ্যমান। পরিবর্তন