ইমতিয়াজ মেহেদী হাসান : মধ্যরাত। নাইটগার্ড ঘুমিয়ে গেছে। পাড়ার হাইতোলা কুকুরগুলো মাতালের বেশে গল্পে মজেছে। দূর থেকে তা পাশের বাড়ির বিড়ালটা দেখছে। আর ভাবছে, সেও যদি একটু গা এলিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে আড্ডায় শামিল হতে পারতো। আহ্, কতই না চমৎকার হতো। ব্যালকনি থেকে দৃশ্যগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছিল নানজীবা। হ্যাঁ, আমি নানজীবা খানের কথা বলছি।
ঠিক ধরেছেন। বয়সে কিশোরী অথচ প্রতিভাতে কাঁচা-পাকা চুলের বুড়ি নানজীবা খান শুধু একটি নামই নয়, বহুজাতিক অনুপ্রেরণার উৎসও। ইতোমধ্যে এ বয়সটাতে নিজের পরিচিতি তালিকায় যোগ করেছেন ট্রেইনি পাইলট, সাংবাদিক, নির্মাতা, উপস্থাপিকা, লেখক, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, বিএনসিসি ক্যাডেট অ্যাম্বাসেডর এবং বিতার্কিক’র উপাধি।
বাতাসে নানজীবার চুলগুলো উড়ছিল। মুখটাও বিষন্ন। জানা গেল, বিভিন্ন কাজ শেষে রাতে ব্যালকনিতে জোৎস্নাবৃষ্টিতে ভিজেছেন তিনি। ঠাঁই দাঁড়িয়ে দেখেছেন কুকুরগুলোর খোশগল্প আর বিড়াল ছানার হাপিত্তেশ। ভোরে এ দৃশ্যগুলোই আবার স্বপ্নে দেখেছেন। এজন্যই বিধ্বস্ত-স্মৃতিকাতর লাগছে তাকে। জামা-কাপড় চেঞ্জ করে আসছি, স্নিগ্ধ হাসিতে প্রতিবেদককে জানালেন নানজীবা। এরপর ড্রয়িং রুম থেকে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে, আবার ফিরে এলেন। বললেন, বেশিক্ষণ বসতে হবে না। আপনার চা শেষ হওয়ার আগেই ফিরে আসছি। জাস্ট একটু ফ্রেশ হবো। বড্ডজোর পাঁচ মিনিট, কেমন?
ঘরের চারদিকে তাকাতেই নানজীবার রুচির পরিচয় পাওয়া গেল। ছিমছাম সাজানো-গোছানো ঘর। চোখ না জুড়িয়ে উপায় নেই। নাস্তার টেবিলে ‘অটিস্টিক শিশুরা কেমন হয়’ শিরোনামের একটি বই রাখা। সেটা হাতে নিতেই নানজীবা এলেন। দারুণ সময়জ্ঞান তার। পাঁচ মিনিটেই এসেছেন। বললেন, বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত। বইটি আমার লেখা। ২ বছরের গবেষনা শেষে চলতি বই মেলায় প্রকাশ করেছি। অন্বেষা প্রকাশনের স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। প্রচ্ছদও নিজের করা।
শুরু হলো কথোপকথন। জানা গেল বর্তমানে তিনি ‘অ্যারিরাং ফ্লাইং স্কুল’ এ ‘ট্রেইনি পাইলট’ হিসেবে অধ্যয়নরত। পাশাপাশি দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’র ‘হ্যালো’ বিভাগের সাংবাদিক, বিটিভির নিয়মিত উপস্থাপক, ব্রিটিশ আমেরিকান রিসোর্স সেন্টারের ব্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নানজীবা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে তিনি দুই ঢোক পানি খেলেন। তারপর নিজের বর্তমান অবস্থানে আসার গল্প শেয়ার করলেন এই প্রতিবেদককের সঙ্গে। বললেন, হাতে কলম ধরার আগেই পাঁচ বছর বয়সে মায়ের হাত ধরে গিয়েছিলাম কিশলয় কচিকাঁচার মেলায়। উদ্দেশ্য ছিল ছবি আঁকা ও আবৃত্তি। মনোযোগ দিয়ে রপ্তের চেষ্টাও ছিল। ২০০৭ সালে জীবনের প্রথম প্রতিযোগিতা জয়নুল কামরুল ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন পেন্টিং কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করে পাই আন্তর্জাতিক পুরস্কার। প্রথম অর্জন ছিল আমার ওই পুরস্কার, আর সেটি আন্তর্জাতিক।
হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতেই নানজীবা বলেন, আমার পথচলা শুরু হয় মূলত ওই ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার হাতে নেয়ার পরেই। ছবি আঁকার জন্য পরবর্তীতে নিজের ঝুলিতে বেশ কিছু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার জমা হয়। থেমে থাকেনি আবৃত্তি চর্চাও। চলতে থাকে। যার প্রেক্ষিতে উৎসব এলেই আমার সকাল থেকে সন্ধ্যা কাটতো বিভিন্ন অনুষ্ঠান মঞ্চে।
আলাপনের ফাঁকে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন নানজীবা। অপলক নয়নে ব্যালকনির দিকে চেয়ে রইলেন। মিনিট দুয়েক পর প্রতিবেদকের ডাকে সাড়া দিলেন। একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর এই চপলা কিশোরী বলেন, হঠাৎ ছেলেবেলার কথা মনে পড়ায় নষ্টালজিক হয়ে গিয়েছিলাম। আহ্ কত মধুর ছিল সেই সময়। ২য় শ্রেণীতে পড়াকালীন সময় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)এর ‘কাগজ কেটে ছবি আঁকি’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। কিন্তু সেদিন ভাবিনি এই অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আমি মিডিয়ায় পা রাখছি। বর্তমানে আমি সেই বিটিভিতে ‘আমরা রঙ্গিন প্রজাপতি’, ‘আমাদের কথা’, ‘আনন্দ ভুবন’, ও ‘শুভ সকাল’ নামের অনুষ্ঠানগুলো উপস্থাপনা করছি। বিষয়টি ভাবতেই ভালো লাগে।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘কেয়ারলেস’ পরিচালনা করেন নানজীবা। এরপর টিফিনের জমানো টাকায় জীবনের প্রথম প্রামাণ্য চিত্র ‘সাদা কালো’ নির্মাণ করেন তিনি। চেষ্টা-শ্রম বৃথা যায়নি তার। সফলতাস্বরুপ অর্জন করেছিলেন ‘ইউনিসেফের মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’। এরপর ‘গ্রো আপ’, ‘দি আনস্টিচ পেইন’সহ আরও কিছু প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করেছেন।
শিশু সাংবাদিক হিসেবেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন নানজীবা। এ পর্যন্ত তিনি সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, সাকিব আল হাসান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সংস্কৃতিমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, ভূমিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী, স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী, মেয়র সাঈদ খোকন, সেলিনা হোসেন, ইমদাদুল হক মিলন, হাবিবুল বাশার, আবেদা সুলতানা, সাদেকা হালিম, নিশাত মজুমদার, ফরিদুর রেজা সাগর, জুয়েল আইচ, মীর আহসান, র্যাবের বেনজির আহমেদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফেরদৌস, ওয়ার্ল্ড ডিবেট সোসাইটির পরিচালক অ্যালফ্রেড স্নাইডার, ভারতের রক্ষামন্ত্রীসহ ৭৫ জন বিশিষ্টজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।
চটপটে স্বভাবের নানজীবা বিতার্কিক হিসেবেও কম যান না। একাদশ শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে তিনি ক্যামব্রিয়ান ডিবেটিং সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্কুল ও কলেজ জীবন মিলিয়ে বিতার্কিক হিসেবে অর্জন করেছেন বেশ কিছু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার। পেয়েছেন উপস্থিত ইংরেজি বক্তৃতায় বিএনসিসি ও ভারত্বেশ্বরী হোমসের প্রথম পুরস্কার।
ততক্ষণে দুপুর গড়িয়েছে। ডাইনিং টেবিলে হরেক পদের খাবার। খেতে ডাকা হলো। প্রতিবেদককে সঙ্গে নিয়ে নানজীবা খেতে বসলেন। থেমে নেই কথোপকথন। চলতেই থাকলো। নানজীবা বলেন, দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে ‘বিএনসিসি ক্যাডেট অ্যাম্বাসেডর’ হিসেবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর থেকে ৩ ধাপে লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার পরে সারা দেশের হাজার হাজার ক্যাডেটদের মধ্য থেকে বিএনসিসি’র সবচেয়ে দীর্ঘ এবং ব্যয়হুল সফর ভারতে অংশগ্রহণ করি। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সাথে সাক্ষাৎ এবং রক্ষামন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ হয়। পাশাপাশি রাশিয়া, ভারত, সিঙ্গাপুর, কাজাকিস্তান, কিরকিস্তান, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপসহ মোট ১১ টি দেশের সামনে বাংলাদেশকে তুলে ধরি। নিয়েছি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘রাইফেলে ফায়ারিং’, ‘অ্যাসোল্ড কোর্স’, ‘বেয়ানোট ফাইটিং’ ও ‘সশস্ত্র সালাম’ প্রশিক্ষণ।
নিজেকে দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশেকে চেনাতে চান নানজীবা। তিনি বলেন, কাজ শেখার চেষ্টা করছি। আশাকরি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সময়ের আগেই পৌঁছাব। কখনই শুধু দেশ নিয়ে ভাবিনা। আমার লক্ষ্য সবসময় আন্তর্জাতিক। আমি চাই মানুষ নানজীবাকে দিয়ে গোটা বাংলাদেশ চিনবে।
জীবনে চলার পথে কৌশলী হওয়াটাও জরুরি বলে মনে করেন নানজীবা। তার মতে, শুধু মিডিয়া না, প্রত্যেক সেক্টরে কাজ করতে হলে কৌশলী হতে হবে। কারণ একটি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দুইটি পিঠই থাকে। তাই অবস্থা বুঝে কৌশল অবলম্বন করতে হবে। ব্যবস্থা নিতে হবে। রাতারাতি তারকা হওয়া হয়তো অনেকটাই সহজ কিন্তু সেই অবস্থান ধরে রাখাটা কঠিন। তাই কাজ শিখছি এবং পরবর্তীতে মিডিয়ার হাল ধরার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি। পাশাপাশি আকাশে ওড়ার স্বপ্নটাও পুরণ করতে নিরলস পরিশ্রম করছি।
ঘড়ির কাঁটায় তখন সাড়ে তিনটা। আরেক দফা চা এলো টেবিলে। সঙ্গে ঝাল চানাচুর আর সল্টেজ বিস্কুট। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নানজীবা তার পরিবারের গল্প শোনালেন এই প্রতিবেদককে। তিনি বলেন, আমার সব কিছুর প্রেরণা আমার ছোট ভাই ও মা। মা আমাকে শুধু সাহায্যই করেননা বরং সে-ই আমার সব অর্জনের প্রেরণা। সারাদিন অফিস করে এসেও সে আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেন, প্রেরণা যোগান। সঙ্গে ছোট ভাইটাতো আছেই। যাকে আমি প্রেরণার ভাণ্ডার বলি। কারণ, যখন কোন কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। তখন ওর কথা মনে করলেই ভেতর থেকে আমি অদ্ভুত ধরণের এক শক্তি পাই। যা আমাকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগায়।
ছেলেবেলায় নানজীবার চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও বয়সের সঙ্গে সে স্বপ্ন বদলেছে। জানালেন সে কথাও। বলেন, মিডিয়াতে তারকা হয়ে কাজ করতে আসিনি, মিডিয়াতে নেতৃত্ব দিতে চাই। সেই সাথে চাই উড়ন্ত পাখিদের সাথে আকাশে উড়তে, মেঘের সাথে কথা বলতে আর আকাশের তারাদের সাথে গল্প করতে।
আর কিছুক্ষণ বাদেই পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়বে। পাখিরা ফিরবে নীড়ে। তাই সময়ক্ষেপণ না করে এবার প্রতিবেদকের বিদায় নেওয়ার পালা। নানজীবার জন্য শুভ কামনা। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন। আজ এ পর্যন্তই।