হাবিব রহমান : নামিদামি ব্র্যান্ডের তার। আসল নাকি নকল দেখে বোঝার উপায় নেই। নকলের বিষয়টি যাতে মাঠ পর্যায়ের বিক্রেতারা না বুঝতে পারেন এ জন্য দামও আসলের মতোই। বিক্রেতাকে খুশি করতে কিছু কমিশন দেওয়া হয়। এই বিপণন কৌশলের কারণেই দেদার চলছে নকল তার। শুধু তারই নয়, বাজারের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের একটি বড় অংশই নকল ও নিম্নমানের। আর এসব সরঞ্জাম ব্যবহারের ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নি দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
নকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জামবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে আসছে এলিট ফোর্স র্যাব। র্যাবের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত শুধু রাজধানীতেই তিনটি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব অভিযানে অন্তত ৮ কোটি টাকার নকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে গ্রেপ্তার চারজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের ফলে শর্টসার্কিট থেকে অগ্নি দুর্ঘটনার সংখ্যাও অনান্য বছরের তুলনায় গত বছরে কয়েকগুন বেড়েছে। বিশেষ করে নকল তার উৎপাদন ও বাজারজাতের ওপর কঠোর নজরদারির কথা বলছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই একটা সময় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির নামি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। পরে চাকরি ছেড়ে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে নেমে পড়েন নকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির কারবারে।
সর্বশেষ গত সপ্তাহে পুরান ঢাকার নবাবপুর মার্কেট থেকে বিআরবি কেবলস, প্যারাডাইস কেবল ও ইস্টার্ন কেবলসসহ সাতটি নামিদামি ব্র্যান্ডের লোগো নকল করে তৈরি করা ৫ কোটি টাকার বৈদ্যুতিক তার জব্দ করে র্যাব। এ ঘটনায় কয়েকজনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজাও দেওয়া হয়।
দন্ডপ্রাপ্ত প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, খাদ্য বা ব্যবহার সামগ্রী নকল করলে নির্দিষ্ট মেয়াদের পর তা বোঝা যায়। কিন্তু বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি থাকে না। এ ছাড়া বেশিরভাগ গ্রাহকই নিজে এসব সামগ্রী কিনতে আসেন না। সাধারণত মিস্ত্রিরাই এসব ক্রয় করেন। দাম কিছুটা কম হওয়ায় মিস্ত্রিরা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে দোকান থেকে আসল পণ্যের বদলে কিনে নেন নকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম।
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম আমাদের সময়কে জানান, নকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির আগে এই চক্রের সদস্যরা ছয় মাস বা এক বছর নামিদামি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সে সময়ই তারা এই বিদ্যা রপ্ত করেন। পরে তারা চাকরি ছেড়ে দিয়ে নকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরি শুরু করেন। আর এসব নকল সরঞ্জামের মূল্য নির্ধারণ করা হয় আসল পণ্যের মতোই। যাতে ক্রেতাদের মনে কোনো সন্দেহ না জাগে।
অগ্নি নিরাপত্তায় নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে প্রায় ১৮ হাজার অগ্নি দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয় ২৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার অগ্নি দুর্ঘটনার কারণ ছিল বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ জানান, সারা দেশের মোট অগ্নি দুর্ঘটনার ৫৫ ভাগই হয়ে থাকে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে। আর শহর অঞ্চলের আগুনের ৭০ ভাগ বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে। এই শর্টসার্কিটগুলোর প্রধান কারণ হচ্ছে, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবহার। ভালো মানের বৈদ্যুতিক সরজ্ঞাম ব্যবহার করলে এ ধরনের দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিতভাবে বাজার মনিটরিং করে থাকে। এ সময় তারা নিজস্ব পণ্যের আদলে তৈরি নকল পণ্যের একটি তালিকাও তৈরি করে। পরে ওই তালিকা অভিযোগ আকারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন তারা।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে ১৭ হাজার ৮৩০টি অগ্নি দুর্ঘটনায় ক্ষতি হয় ৩৫৯ কোটি টাকার। প্রাণ হারান ৭০ জন। পরের বছরেও প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৬৮ জন। ওই বছর আর্থিক ক্ষতি হয় ৮৫৬ কোটি টাকা।
সর্বশেষ গত ৫ জানুয়ারি বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকা-ের ঘটনাটি ঘটে গুলিস্তানের পাতাল মার্কেটে। ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট টানা ৪০ মিনিট কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।