সাইফুর সাগর : ফেসবুকে ভাইরাল ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জির সফরকালে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে তোলা স্থিরচিত্র গুলো। প্রশ্নের ধরণে সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠা বহুগুণে পরিলক্ষিত হয়েছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। আমার টাইমলাইনে ভাসমান অনেকগুলো ছবি থেকে এই ছবিটুকুর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম, কেনো এতো উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ মানুষের। যা বুঝলাম প্রথমত, প্রণব বাবু বাংলাদেশের জামাই এবং তাঁর আত্মার বিশাল একটা অংশজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। কথিত আছে, স্বাধীনতার অন্যতম সংগঠক বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে রয়েছে তার দারুন সখ্যতা। ব্যক্তিগতভাবে তিনি পরিবারটির সঙ্গে দীর্ঘদিন পারিবারিক যোগসূত্র বজায় রেখে চলেছেন। আওয়ামী সরকারের ভারত প্রীতি সেতুবন্ধনের মধ্যমনি এই সাবেক অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জী। তার সম্প্রতি লেখা বইতে তিনি অনেক জায়গায় উল্ল্যেখ করেছেন, কিভাবে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমান সরকারের পাশে (পক্ষালম্বন) ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী নিজে রান্না করে খাওয়ান তার পারিবারিক বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনকে, নিজের ঘরে তিনি প্রধানমন্ত্রী নন বরং তিনি গৃহিনী হয়ে যে কাউকে খাওয়াতে বা আপ্যায়ন করতে পারেন, এটা তাঁর একদম ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অথবা দ্বিরাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশ ও ১৮ কোটি মানুষের সন্মান বহন করেন. তিনি নিজের ইচ্ছা মতো যা খুশি করতে পারবেন না। তার প্রতিটি চাল চলন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। যে ছবিটি নিয়ে এতো উত্তাল সর্বাঙ্গন, আমিও একজন বাংলাদেশী হিসেবে মেনে নিতে পারিনি। ছবিগুলো একটা হাইকমিশনে অনুষ্ঠেয় অনুষ্ঠানের ছবি। ছবিটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক শুরু হলে, বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যম বিষয়টিকে খোলাসা করতে গিয়ে বলেছেন, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি অসুস্থ ছিলেন বলেই তাকে চেয়ারে বসিয়ে ছবি তুলেছেন। অথচ সম্মানিত অতিথি দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে স্বাভাবিক শরীরেই হিন্দুস্থান থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। পেছনের সারিতে যারা রয়েছেন, তাদের কয়েকজনের বয়স প্রণব মুখার্জির চাইতেও ৪/৫ বছরের বেশি।
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ কিছুদিন পর পর চিকিৎসার জন্যে হসপিটালে ভর্তি হন। মুহিত সাহেব কিছুদিন আগেও অসুস্থতা অনুভূত করে রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই সব অসুস্থতার ব্যাপারগুলো ভারতীয় হাইকমিশন খুব ভালো করেই জানে। প্রটোকলের দিক দিয়ে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত জেনারেল এরশাদ ছিলেন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রধান। প্রণব বাবু ভারতের প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারের রাষ্ট্রপতি হয়ে মাত্র অবসরে গেলেন। মনে রাখতে হবে, এখানে চেয়ার দেয়া এবং চেয়ারে রাষ্ট্রপতিকে বসানো হঠাৎ করেই হয়নি। একটা হাইকমিশণে প্রতিটি আচার ও অনুষ্ঠান পূর্বপরিকল্পিত এবং সাজানো থাকে আগে থেকেই। হয়তো শ্রী প্রণব বাবু ও এসবের কিছুই চাননি, যত দোষ এই নন্দ লালের (হাইকমিশনের)। বাংলাদেশে অবস্থিত শত শত দূতাবাসের মধ্যে ভারতীয় দূতাবাসের আলাদা একটা মনোভাব নিয়ে পরিচালিত হয় ঢাকাতে। নিজেদের ঢাকার মুরুব্বি এবং বাংলাদেশের অভ্ভন্তরীন বিষয়ের উপর অহেতুক নাক গলানোর অভ্যেস এবং মানসিকতা থাকে সব সময়। অথচ একই হাইকমিশনার অন্য কোনো দেশে গেলে হাবা গোবার মতোই দায়িত্ব পালন শেষ করে ভারতে ফিরে যায়। শুধুমাত্র বাংলাদেশে আসলেই তাদের এই মনোভাবের কারণ আমরা সবাই বুঝি, বুঝেও অনেকেই না বোঝার ভান করে থাকি।
আজকাল পাশের দেশ নেপালেও ভারত নাক গলানোর সাহস পায়না। সাহসিকতার সাথে এবং আনুষ্ঠানিক ভাবেই নেপাল ভারতের অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করেছে। কয়েক মাস আগে নেপালের একজনকে হত্যার মূল্য সর্বোচ্চ মর্যাদায় দিয়েছে যা আমরা সকলেই জানি। পাশ্ববর্তী দেশে হস্তক্ষেপ পরবর্তীতে দখল করে নিজের দেশের অংশ হিসেবে ঘোষণা করার ইতিহাস ভারতের রয়েছে। সিকিমবাসীরা আজো সেই প্রহসনের শিকার হয়ে আছে। ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু অবধি ভুলের মাশুল ও ক্ষমা চেয়েছিলেন লেন্দুপ দর্জি, ক্ষমা পাননি সেই হতভাগা। আমরা স্বাধীনতার নামে পরাধীনতা চাইনা. পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি শুধুমাত্র একটি কারণেই তা হলো, পরাধীনতা। সেই পরাধীনতা যদি আমাদের এখনো গ্রাস করে রাখতাহলে স্বাধীনতার সাধ কিভাবে পাবো? যারা বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন, একই ছবিটি যদি এমন হতো, সামনে এরশাদ সাহেব বসে আছেন, আর পেছনে প্রণব বাবু দাঁড়িয়ে আছেন, বিষয়টি কেমন লাগতো? ভারতীয়রা কিভাবে নিতেন ব্যাপারটিকে?
বছর আগে, ক্রিকেট খেলার উপর বাংলাদেশের মুস্তাফিজকে নিয়ে প্রথম আলো একটি ছবি দিয়েছিলেন ‘কাটার মুস্তাফিজ’ শিরোনামে সেদিনের হেডলাইন করেছিল পত্রিকাটি। ভারতীয় খেলোয়াড়দের নিয়ে ওই লেখাটির প্রতিবাদে সপ্তাহ ব্যাপী ভারতের প্রায় সব কোটি নিউজ চ্যানেলে বাংলাদেশকে নিয়ে কটূক্তি এবং দুস্বাহসের কথা বলা হয়েছিলো। তারা বাংলাদেশকে বিন্দু মাত্র সন্মান দিয়ে কথা বলেননি। একটি খেলাকে কেন্দ্র করে তারা যেভাবে একটা দেশকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য দেখিয়েছে তাতে নিতান্তই লক্ষিত হয়েছে যে তারা বাংলাদেশকে খুব ছোটো ভাবেই দেখে। অপ্রিয় হলেও সত্য, ভারত এই ধরনের দুঃসাহস দেখায় শুধুমাত্র আওয়ামীলীগ সরকারের আমলগুলিতে। কারণ তারা জানে, আওয়ামীলীগ আমল মানেই বাংলাদেশ ভারতের, এমন আত্মবিশ্বাস থেকেই তাদের নাক গলানোর স্পর্ধা ও কটূক্তির সাহস দেখিয়ে থাকে বাংলাদেশের প্রতি। এই সুযোগ গুলি আমাদের অভ্ভন্তরীন রাজনৈতিক অসমতা অনৈক্যই একমাত্র দায়ী। আমরা নিজেরাই অন্যদেরকে ডেকে এনে স্বাধীনতা খর্ব করার সুযোগ দিয়েছি। এভাবে চলতে থাকলে স্বাধীনতার নূন্যতম বিলাসিতা থেকেও বঞ্চিত হবো। সিকিমের মতো ভাগ্য হতে পারে আমাদেরও। তাই সাধু সাবধান।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক, মন্ট্রিয়ল, কানাডা।
সম্পাদনা : খন্দকান আলমগীর হোসাইন