শিরোনাম
◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো ◈ রেকর্ড বন্যায় প্লাবিত দুবাই, ওমানে ১৮ জনের প্রাণহানি

প্রকাশিত : ১৯ জানুয়ারী, ২০১৮, ০৬:০৯ সকাল
আপডেট : ১৯ জানুয়ারী, ২০১৮, ০৬:০৯ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

স্যালুট পূর্ণিমা, ধন্যবাদ তারানা

প্রভাষ আমিন : সামাজিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের গণমাধ্যম ধর্ষিতার নাম-পরিচয় প্রকাশ করে না। যদিও অপরাধটা ধর্ষকের, কিন্তু বাংলাদেশে সামাজিকভাবে হেয় করা হয় কোনও অপরাধ না করা ধর্ষিতাকে। তাই ধর্ষণের অনেক ঘটনা আড়াল করা হয়। জানাজানি হলে নিরপরাধ মেয়েটি হয় বিষ খায়, ফ্যানে ঝুলে পড়ে। কেউ দেশ ছাড়েন, কেউ এলাকা ছাড়েন, কেউ পালিয়ে বাঁচেন। যারা ধর্ষিত হওয়ার পর বেঁচে যান, তারা মরেন প্রতিদিন। বেঁচে যাওয়ার পর তাকে প্রতিদিন মানসিকভাবে ধর্ষিত হতে হয়। গণমাধ্যম, হাসপাতাল, থানা, পুলিশ, আদালত- সর্বত্রই হেনস্থা করা হয় মেয়েটিকে। প্রথমে হাসপাতালে ধর্ষণের প্রমাণ দিতে হয়, তারপর পুলিশের কাছে ধর্ষণের খুটিনাটি বিবরণ দিতে হয়। অভিযোগ যদি আদালত পর্যন্ত যায়, তাহলে প্রকাশ্য আদালতে আইনজীবীর অশ্লীল জিজ্ঞাসাবাদে বারবার ধর্ষিত হতে হয়। এই দীর্ঘ দুর্ভোগ সইবার মতো মানসিক শক্তি সবার থাকে না। ধর্ষণের শিকার মেয়েটি প্রথম সুযোগেই দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করে তার শরীর থেকে, মন থেকে সেই গ্লানির চিহ্ন মুছে ফেলতে চায়। তাই হাসপাতাল, থানা, পুলিশে গিয়ে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়। আর ধর্ষণের কোনও সাক্ষী থাকে না।

তাছাড়া আমাদের আইনটাই এমন ধর্ষকের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। চেষ্টা করা হয় ধর্ষিতাকে নষ্টা, চরিত্রহীনা প্রমাণের। আর এটা প্রমাণ করতে পারলেই যেন জায়েজ হয়ে যায় ধর্ষণ। কিন্তু মেয়েটি যৌনকর্মী হলেও, এমনকি আপনার বিয়ে করা স্ত্রী হলেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করা যাবে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে কোনও সম্পর্ক অপরাধ। কিন্তু আমাদের দেশে যেই পশুটা ধর্ষণ করে, তার পক্ষে হাজার যুক্তি- বয়সের দোষ, পোলাপান একটু-আধটু এমন করেই, মেয়েটা কেন অত রাতে অমন পোশাকে বাইরে এলো, মেয়েটা কেন জন্মদিনের অনুষ্ঠানে হোটেলে গেল, মেয়েটা কেন হেসে কথা বললো, মেয়েটা কেন ফিরে তাকালো। খলের কখনও ছলের অভাব হয় না। নেকড়ে ভেড়াটাকে খাবে। ব্যস, এর জন্য যুক্তির অভাব হবে না।

গণমাধ্যমে ধর্ষিতার নাম-পরিচয় ছাপা হয় না বটে, তবে গণমাধ্যমের মূল আগ্রহ ধর্ষণের রগরগে বর্ণনায়। নাম ছাপা না হলেও এলাকার মানুষ ঠিকই চিনে যায় ধর্ষিতাকে। সবাই তার দিকে আঙুল তুলে বলে, ওই দেখো ধর্ষিতা যায়। তারপর চলে রগরগে আলোচনা। এই যখন বাস্তবতা, তখন একটি মেয়ে আমাদের পথ দেখায়, সাহসী করে। সেই মেয়েটির গল্পই বলবো আজ।

গণমাধ্যমে ধর্ষিতার নাম ছাপা না হওয়ার বিষয়টি আমাদের মনোজগতে গেঁথে আছে। তাই ফেসবুকে তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের একটি স্ট্যাটাস দেখে চমকে গেলাম। তারানা হালিম আমার বন্ধু তালিকায় নেই, তাই প্রথমে চোখে পড়েনি। কিন্তু সমালোচনার ঝড় দেখে খুঁজে খুঁজে তার টাইম লাইনে গেলাম। চলুন আগে স্ট্যাটাসটি দেখে নিই, ‘মনে পড়ে সেই পূর্ণিমাকে? ২০০১ এর ১ অক্টোবর নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপি-জামাতের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ১৪ বছরের মেয়েটি। হ্যাঁ, আমি সিরাজগঞ্জের সেই পূর্ণিমা শীলের কথা বলছি। আজ আমি গর্বিত আমি পূর্ণিমাকে আমার পার্সোনাল অফিসার হিসাবে নিয়োগ দিলাম। পূর্ণিমা, তোমাকে আমরা ভুলে যাইনি। জীবনের অন্ধকার রূপ তুমি দেখেছো, আলোর জগতে তোমায় স্বাগতম...। শুরু হোক নতুন পথচলা। তোমাকে অভিবাদন প্রিয় পূর্ণিমা।’

স্ট্যাটাসে মন্ত্রীর সাথে পূর্ণিমার কয়েকটি ছবিও আছে। স্ট্যাটাসটি দেখে প্রথমে আমিও চমকে গিয়েছিলাম। সমালোচনার কারণও সেটাই। একজন প্রতিমন্ত্রী, যিনি আবার নারী, তিনি কিভাবে একজন ধর্ষিতার নাম প্রকাশ করলেন, ছবি প্রকাশ করলেন। সবাই বলছেন, প্রতিমন্ত্রী সস্তা জনপ্রিয়তার জন্যই এই কাজটি করেছেন। পূর্ণিমাকে পারসোনাল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তারানা হালিম যতটা ধন্যবাদ পাচ্ছিলেন, তার নাম ও ছবি প্রকাশ করে নিন্দা কুড়িয়েছেন তার চেয়ে বেশি। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলাম, এখানে মন্ত্রীর কোনও দায় নেই।

পূর্ণিমাই চেয়েছেন তার নাম-ছবি প্রকাশিত হোক। তারানা হালিম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পূর্ণিমা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী মেয়ে। নিয়োগ দেওয়ার পর ফেসবুক পেইজে ছবি দেওয়ার সময় তার ছবি আমি ব্লার করে দিতে চেয়েছিলাম, সে বললো, ছবি দিতে কোনও সমস্যা নেই, এটি আমার লজ্জা না।’ পূর্ণিমার কথা শুনে আমি একটুও অবাক হইনি। এই পূর্ণিমা আগেও বারবার আমাকে চমকে দিয়েছেন। ধর্ষণের পর সবাই যখন মুখ লুকাতে ব্যস্ত, তখন রুখে দাঁড়িয়েছেন পূর্ণিমা। গতবছর বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকিতে অংশ নিয়ে সরাসরি টেলিভিশনে নিজের সংগ্রামের বর্ণনা দিয়েছিলেন পূর্ণিমা। এর আগেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, টিভিতে, ডকুমেন্টারিতে কথা বলেছেন পূর্ণিমা। বারবার বলেছেন, আমি মুখ লুকাবো কেন? লজ্জা তো আমার নয়। যারা ধর্ষণ করেছে, যারা তা ঠেকাতে পারেনি, লজ্জা তাদের। পূর্ণিমা কখনোই নিজেকে আড়াল করতে চান না, লড়াই করতে চান। পূর্ণিমা একটি অসাধারণ লড়াকু নারী। ২০০১’র সালের পর কেটে গেছে ১৭টি বছর। পূর্ণিমা এই সময়ে নিজেকে গড়ে তুলেছেন আরো যোগ্য করে। পূর্ণিমা ফাউন্ডেশন গড়ে সচেতনতা তৈরি করছেন ধর্ষণের বিরুদ্ধে। এই ১৭ বছরে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে। বারবার হেনস্থার শিকার হয়েছেন। ঝড়ের সময় সুপারি গাছ দেখেছেন? ঝড়ে একদম নুয়ে পড়ে, মনে হয় এই বুঝি ভেঙে গেলো। আবার দাঁড়িয়ে যায়। পূর্ণিমা সেই সুপারি গাছের মতো। বারবার ঝড় এসে তাকে ভেঙে ফেলতে চেয়েছে হয়তো, কিন্তু আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন তিনি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেলিকমিউনিকেশনে পড়াশোনা শেষ করেছেন। তাই একজন প্রতিমন্ত্রীর পারসোনাল অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া তার জন্য বাড়তি কোনও ফেভার নয়। বরং যোগ্যতার চেয়ে কম পদে চাকরি দেওয়া হয়েছে তাকে।

১৭ বছর আগে পূর্ণিমা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, এটা তার পরিচয় নয়, তার করুণা পাওয়ার যোগ্যতা নয়; পূর্ণিমা একটি শিক্ষিত, আত্মবিশ্বাসী, লড়াকু মেয়ে; এটাই তার যোগ্যতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূর্ণিমার পড়াশোনায় সহায়তা করেছেন, তার পাশে ছিলেন। কিন্তু পূর্ণিমাকে তার লড়াইটা তাকেই লড়তে হয়েছে। এবং ১৭ বছরে সে বুঝিয়ে দিয়েছে, তাকে হারানো যাবে না। তবে তারানা হালিম নিছক প্রচারণার জন্য পূর্ণিমাকে তার পারসোনাল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, এটা আমার মনে হয়নি। আমি তারানা হালিমকে যতটুকু চিনি, তাতে তিনি আন্তরিকভাবেই পূর্ণিমার পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন, তাকে মর্যাদা দিতে চেয়েছেন। এ জন্য তারানা হালিমকে ধন্যবাদ।

এই মর্যাদার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ণিমা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, আমরা যেভাবে ভাবি, আসলে উল্টো করে ভাবা উচিত। ধর্ষিতা একজন ভিকটিম, অপরাধী নন। তাই তার নাম গোপন রেখে আসলে ধর্ষকদের ইচ্ছাকেই মূল্যায়ন করা হয়। কারণ সবসময় ধর্ষণ নিছক কাম চরিতার্থ করার জন্য করা হয় না। ধর্ষকের কাছে ধর্ষণ হলো নারীদের ওপর তার আধিপত্যের সূচক। সে দেখিয়ে দিতে চায়, দেখো তোমাকে নষ্ট করে দিলাম। সমাজে তোমার কোনও ঠাঁই নেই। পূর্ণিমা আমাদের সেই ভাবনার গলদে টান দিয়েছেন। মাথা উঁচু করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে বলছেন, আমার কোনও লজ্জা নেই, যারা ধর্ষণ করেছে, লজ্জাটা তাদের।

পূর্ণিমা আমাদের বাতিঘর হতে চেয়েছে, পথ দেখাতে চেয়েছে। নাম পূর্ণিমা, তিনি আসলে সূর্যের মতো তীব্র আলো নিয়ে এসেছেন। কিন্তু পথটা এত অন্ধকার, আমাদের চোখ ঝলসে গেছে। পথ এতটা বন্ধুর, সেই পথে হাঁটার মতো সামর্থ্য, সাহস আমাদের নেই। আমরা হয়তো এখনই পূর্ণিমার মতো করে ভাবতে পারবো না, তার মতো সাহসী মেয়ে হয়তো বেশি নেই।

তাই আমাদের আরও অনেকদিন ধর্ষিতার নাম-পরিচয় গোপন রেখেই তাদের সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে অল্পকিছু ধর্ষকামী পুরুষ ছাড়া আমরা সবাই যেন ধর্ষিতাদের মর্যাদার বিষয়টি মাথায় রাখি, তাদের যেন করুণা না করি। আমাদের ভাবনার গলদটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য, আমাদের সমাজের গহীনে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারে আলো ফেলার জন্য পূর্ণিমাকে স্যালুট।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ । বাংলাট্রিবিউন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়