পীর হাবিবুর রহমান : সাত দিনের ব্যবধান খুব কম। একটি বিষয় নিয়ে লিখতে ভাবী, কিন্তু তা হয়ে ওঠে না। সাত দিনে অনেক কিছুই ঘটে যায়। ঘটনাবহুল মানব জীবন, সমাজ-সংসার সবকিছু্ই। লেখার হিসাবের খাতাও তাই ওলট-পালট, এলোমেলো হয়ে যায়। এক মাস আগেই যশোরের স্নেহভাজন রোটারিয়ান গিয়াস উদ্দিন খান ঢালুর আমন্ত্রণে তাদের অফিসের এক অনুষ্ঠানে অতিথি হওয়ার সম্মতি দিয়েছিলাম। ১৫ ডিসেম্বর শুক্রবার ছিল সেই অভিষেক। সকালের ফ্লাইট দুপুরে গড়াল। আগের রাতেই চট্টগ্রামের তিনবারের নির্বাচিত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ভোরের আলো ফোটার আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চশমাহিলের বাড়িতে ফিরলেন লাশ হয়ে। তার সঙ্গে পেশাদারিত্বের তারে জড়ানো নিবিড় সম্পর্ক প্রায় তিন দশকের। তার কথায় পরে আসছি। ভাবছিলাম, যে বীরযোদ্ধার নেতৃত্বে দেশের অভ্যন্তরে ভারতের সহযোগিতা ছাড়া কাদেরিয়া বাহিনী বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল; সেই বাহিনীর প্রধান ও একমাত্র বেসামরিক বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে দাওয়াত না করে টাঙ্গাইলে বিজয় দিবসের সপ্তাহব্যাপী উৎসব পালিত হয়; তা নিয়ে লিখব। মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্ব মুক্তিকামী মানুষকে শিহরিত করেছিল। উজ্জীবিত করেছিল। বাইরের দুনিয়া চিনেছিল একজন বাঘা সিদ্দিকীকে। তার নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাস্তই হয়নি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন। তার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধের অনন্যসাধারণ সংগঠকই নন, টাঙ্গাইলে উড়িয়েছিলেন প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবদুল মান্নান, শামছুর রহমান খান ইন্তেকাল করেছেন। বেঁচে আছেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও শাজাহান সিরাজরা। বীরত্বের মুকুট পরে মাথা উঁচু করে আছেন, বাঘা সিদ্দিকী খ্যাত কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। তাদের বাদ দিয়ে টাঙ্গাইলে যখন বিজয় উৎসব হয়, তাকে ইতিহাসের চিরসত্যকে অস্বীকার করে নিষ্প্রাণ, আবেগ-অনুভূতিহীন দায়সারা উৎসব বলে মনে হয়। তাকে অস্বীকার করে এ ধরনের আয়োজন তাকে শুধু অসম্মান নয়, নিজের সঙ্গে আত্মপ্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আমার কোনো আত্মীয়তা নেই। কোনো বৈষয়িক সম্পর্কের চিহ্নও নেই। একজন জাতীয় বীরের প্রতি একজন দেশপ্রেমিক মানুষের যে সম্মান ও আবেগ-অনুভূতিতে লালিত আত্মার বন্ধন থাকার কথা, সেটিই রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি প্রতিটি মানুষের জীবনে ভুলত্রুটি, ভালোলাগা, মন্দলাগা অনেক দিক থাকে। না হলে তিনি মানুষ থাকতেন না; ফেরেশতা হয়ে যেতেন। কাদের সিদ্দিকী জীবনে দুবার যে বীরত্ব দেখিয়েছেন; তাতে তার সব ভুলত্রুটি ভেসে যায় অনায়াসে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বিপথগামী খুনি সেনা সদস্যরা অস্ত্রের জোরে যখন উল্লাস করছিলেন; সব বাহিনীর প্রধান খুনি মোশতাকের অবৈধ ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন; জাতির জনকের বুলেটবিদ্ধ নিথর দেহ খুনিদের প্রহরায় ধানমন্ডির বাড়িতে অনাদর-অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছিল; পরিবারের সদস্যদের বনানীর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল; বঙ্গবন্ধুর লাশ কঠোর নিরাপত্তায় টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে সমাহিত করা হয়। খুনিরা সেদিন মৃত মুজিবকেও ভয় পেয়েছিল। গোটা দেশের মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়ে তাদের জানাজায় মানুষের অংশগ্রহণের পথ অস্ত্রের জোরে বন্ধ করা হয়েছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে খুনিরা পরিবার-পরিজনসহ যেমন বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, তেমনি সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে চরম ব্যর্থ হয়েছে। জনকের লাশের ওপর দিয়ে বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের সঙ্গে তার সহকর্মীরা মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের মতো বিশাল দল দেশজুড়ে একচ্ছত্র আধিপত্য রাখলেও একজন নেতাও বেরিয়ে প্রতিরোধ-প্রতিবাদের ডাক দিতে পারেননি। সেদিন দলের কোনো দায়িত্বশীল নেতা না হয়েও বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর আরেক সন্তান জীবিত বলে যে প্রতিরোধযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন; সেখানে ১৭ হাজার কর্মী যোগ দিয়েছিলেন। শতাধিক কর্মী শহীদ হয়েছেন। নির্বাসিত জীবনে কষ্ট আর যন্ত্রণা সয়ে আসা বাঘা সিদ্দিকী সেই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে মাংস মুখে তোলেননি। তবু সমাজ এতটাই বোধহীন তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা তাকে দিতে পারেনি। কিন্তু ইতিহাস যেভাবে সত্যের ওপর তাকে বীরত্বের আসন দিয়েছে, সেখানে বলতেই হয়; বাঘা সিদ্দিকী তোমাকে অভিবাদন।
যাক, বিমানবন্দরে দেখা হয়ে গেল বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল-নোমানের সঙ্গে। চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুতে মন খারাপ নিয়ে নোমান বললেন, ‘রাজনীতির বাইরেও আমরা ছিলাম মামা-ভাগ্নে।’ সেখানে আরও দেখা হলো রোটারি ডিস্ট্রিক্টের বিদায়ী গভর্নর সাফিনা রহমানের সঙ্গে। রোটারিয়ান যে একটি পরিবার এবং তাদের মধ্যে একটি পারিবারিক বন্ধন, তা তার তৎপরতায় আবার দেখলাম। দেশের ১২ হাজার রোটারিয়ান মানবতার সেবায় নিয়োজিত। ১৯০৫ সালে আইনজীবী পল হ্যারিস যে রোটারি ক্লাবের জন্ম দিয়েছিলেন, তা এখন রোটারি ইন্টারন্যাশনাল। পৃথিবীজুড়ে ১২ লাখ সদস্য। দুনিয়া থেকে পোলিও রোগ বিতাড়নে বিস্ময়কর অবদান রেখেছেন রোটারিয়ানরা। পারেননি কেবল পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে। যশোরের অনুষ্ঠানে রোটারি ডিস্ট্রিক্ট নতুন গভর্নর খায়রুল আলমের সঙ্গেও দেখা হলো। রোটারিয়ানদের মধ্যে নিজের রোজগারের অর্থ খরচ করে মানবসেবার নিরন্তর প্রয়াস রয়েছে। নেতৃত্বের কোন্দল-বিভেদ কিছুই নেই। সমাজকে আলোকিত করা, মানবসেবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সুখ আহরণ করছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে নড়াইলের সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক। চিত্রা নদীর তীরে সুন্দর-ছিমছাম শিল্পী সুলতানের শহর নড়াইল। তরুণ বয়সে বহুবার গিয়েছি। বন্ধু সাইফুর রহমান হিট্টু ও আকরাম খান দিলুর পরিবারের সঙ্গে আত্মার বাঁধন। দিলু যশোরেই থাকে। বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা নিরহংকারী সহজ-সরল জীবনে অভ্যস্ত হিট্টুকে মানুষ সম্মান করে, ভালোবাসে। এটা আমার জন্যও গর্বের। রাতেই নড়াইল চলে যাই। দিলু ও পলাশ পৌঁছে দেয়। অনেক দিন পর হিট্টু আর আমি মন খুলে আড্ডা দিয়েছি। চিত্রা নদীর ওপর সেতু দিয়ে শেখ হাসিনা তার ওয়াদা পূরণ করেছেন। মানুষের দুর্ভোগ শেষ হয়েছে। যশোর-নড়াইল সড়কটি ছয় লেনে আগামীতে প্রশস্ত হবে। কিন্তু রাস্তার ভাঙাচোরা চেহারা দেখে বিমর্ষ হয়েছি। ব্যথিত হয়েছি। সেই নড়াইলের চেহারা এখন অনেক বদলে গেছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন নির্বাসনে পাঠিয়েছে সামাজিক বন্ধন ও মূল্যবোধ। চরমপন্থি নেই। তবুও আছে হানাহানি-খুনোখুনি। ঠিকাদারি ব্যবসা-বাণিজ্যের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। নষ্ট রাজনীতিবিদ, প্রকৌশল দফতর নিয়ন্ত্রিত ঠিকাদার সিন্ডিকেট মিলে নড়াইল এখন মাফিয়াদের হাতে। সহজ-সরল মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও যন্ত্রণা। বন্ধু মনির মল্লিক বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। অধ্যাপনার পাশাপাশি লিটু এখনো গান করে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নড়াইল এখনো অগ্রসর। মনির মল্লিকের মেয়েটি ভীষণ মেধাবী। সলিমুল্লাহ মেডিকেলে সুযোগ পেয়েছে। রূপবতী ও গুণবতী বউ নিয়ে তার্কিক মনির মল্লিক পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করছে দেখে ভালোই লাগল। ক্যান্সার জয় করেছে বান্ধবী মলি। সুলতানের বাড়িতে গেলাম। শিশুস্বর্গসহ সবকিছুতে যেন একটা অবহেলার ছাপ। বিজয় দিবসের সন্ধ্যায় প্রেস ক্লাবে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে প্রাণবন্ত আড্ডাও হলো। প্রেস ক্লাবের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তিন তলা প্রেস ক্লাব সরগরম থাকে। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সংবাদকর্মীরা প্রেস ক্লাবকে মনের মতো করে সাজাবার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। ওয়াই-ফাই অতিথিসহ সদস্যদের চা-নাশতা ফ্রি করে দিয়েছেন। নড়াইল প্রেস ক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট আলমগীর সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক মীর্জা নজরুল ইসলাম। তাদের আতিথেয়তা ও আন্তরিকতা মনে রাখার মতো। টিপু ও তারিকের সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হলো।
যাক, শুরুতেই বলছিলাম চট্টগ্রামের জননন্দিত নেতা মরহুম এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সম্পর্কে কিছু লিখতে চাই। কবি হাসান হাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘এ দেশে বীর নেই, শহীদ আছে’। অর্থাৎ জীবিতকালে আমরা কাউকে তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে পারি না। মারা গেলে তার গুণকীর্তন করি। এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীরও অন্তহীন বেদনা ও দুঃখ ছিল। অভিমান ছিল। কিন্তু একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ববান ও দৃঢ়চেতা সাহসী রাজনীতিবিদ হিসেবে সেই বেদনা আড়াল করে পথ চলতে জানতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার ব্যক্তিত্ব ও উঁচু মাথাকে নত না করে চট্টগ্রামের মানুষ ও রাজনীতির স্বার্থে অটল থেকে গেছেন। মনে পড়ে, সেই ’৯১ সালে যখন প্রথম দলীয় কার্যালয়ে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছিলাম। নোটবুকের কলম থামিয়ে অবাক হয়ে তাকাচ্ছিলাম। পাশে বসা একসময়ের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তিতুল্য ছাত্রনেতা খোরশেদ আলম সুজন আমার চেহারা দেখে হাসছিলেন। আমি তৎকালীন মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের ভাষা, বক্তব্য ও বাচনভঙ্গি দেখে চমকে উঠছিলাম। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন অবিচল। তার রাজনৈতিক জীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদী মহিউদ্দিন চৌধুরী ভারতে ছিলেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অকুতোভয় এই সংগ্রামী নেতা ছিলেন অসাধারণ সংগঠক। কর্মীবান্ধব, গণমুখী ও রাজনৈতিক চরিত্র দিয়ে চট্টগ্রামবাসীর হৃদয়ই জয় করেননি; বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করেছেন। তিনবার মেয়র নির্বাচিত হয়ে সরকারি বরাদ্দ ছাড়া কীভাবে একটি নগরী পরিচ্ছন্ন উন্নত নগরীতে পরিণত করা যায়, তিনি তা দেখিয়েছেন। ২০০৫ সালে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে বিএনপি শাসনামলে সরকারদলীয় প্রার্থী মীর নাছির উদ্দিনকে পরাজিত করেছিলেন। সেই ভোটযুদ্ধে তার নির্বাচনী সমন্বয়কারী আজকের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। চট্টগ্রাম যাওয়ার আগে তিনি ফোন করে বললেন, ‘তুমি চলে আসো।’ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও রসিকতার সঙ্গে টেলিফোনে বললেন, ‘তুমি কাভার করতে এলে ভোটযুদ্ধে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।’ আমার তখনকার অফিস থেকে অগ্রজ সহকর্মী শাহজাহান সরদার ও সাইফুল আলম অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে আমাকে পাঠালেন। সঙ্গে অকালপ্রয়াত পরিশ্রমী রিপোর্টার হোসাইন জাকির, শাহেদ সিদ্দিকী, ফটোসাংবাদিক শামিমুল হক। ভোররাতেই চট্টগ্রাম নেমে রিকশাচালককে জিজ্ঞাসা করলাম, কে হবে আপনাদের মেয়র? রিকশার পেডেল ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি নির্দ্বিধায় বললেন, হারিকেন। যেই হোটেলে উঠেছিলাম, সেটির মালিক বিএনপির সমর্থক। হোটেলবয় বললেন, এই হোটেলে বিএনপির নেতারা উঠেছেন। কিন্তু জিতবে হারিকেন। হারিকেন মানে মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রতীক। পরদিন দোকানপাট, সিএনজিচালক, সাধারণ মানুষ যাকে জিজ্ঞাসা করি, সে-ই বলছিল, হারিকেন আর হারিকেন। পথে পথে বিএনপি প্রার্থী মীর নাছিরের ডিজিটাল ব্যানার, পোস্টার আর একের পর এক নির্বাচনী অফিস। মহিউদ্দিন চৌধুরীর নির্বাচনী কার্যালয় একটি। সেখানে বসেন ওবায়দুল কাদের। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের টিম করে পাঠান বিভিন্ন দিকে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর হালি শহরের বাসভবনে গিয়ে দেখলাম, অতি সাধারণ বাড়ি। পুরনো আসবাবপত্র। একটি দোতলা ছোট্ট পাকাঘর তিনি তৈরি করছেন। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরী পুরনো ঘরেই ঘুমান। বাইরে রান্নাবান্না হচ্ছে। তার বাসভবনে তিনি থাকুন আর না থাকুন নিয়মিত রান্নাবান্না হয় বছরের পর বছর। বাড়িতে যিনিই আসবেন, যেখান থেকেই আসেন না কেন; তাকে খাওয়া-দাওয়া করেই যেতে হয়। তার ইন্টারভিউ নিতে গেলাম দুপুরবেলায়। তিনি বললেন, ‘পীর সাহেব! আগে খেয়ে নেন।’ তার ছোট্ট বেডরুমের মেঝেতে দস্তরখানা বিছিয়ে খাবার আয়োজন। সেই নির্বাচন কাভারকালীন কয়েক দিন তার সঙ্গে খেতে হয়েছে। সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান। বাইপাস হওয়ার পরও তাকে দেখলাম নিয়মিত ‘আগনী’ খেতে। ঢাকায় যেটি তেহারি, চট্টগ্রামে সেটি আগনী। সিলেটে বলে আখনী। সেই নির্বাচনের আগের দিন প্রচারণা বন্ধ, থমথমে পরিস্থিতি। নেতারা সলাপরামর্শ করছেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী একটি মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে কখনো বাটন টিপছেন। সন্ধ্যার পর তার বাসভবনে শত শত তরুণ। ফটোসাংবাদিক শামীমকে পাঠালে ফিরে এসে বললেন, মহিউদ্দিন চৌধুরী ১০০ টাকা দিয়ে বলেছেন, এটা তবারক। চট্টগ্রামের ডিসি গিয়েছিলেন। তাকেও দিয়েছেন। সবাইকে ১০০ টাকা করে তবারক দিলেন তিনি। নেতারা আশঙ্কা করছিলেন, গণরায় ছিনতাই হবে। মহিউদ্দিন চৌধুরী তার মতো সব ওয়ার্ডের কর্মীদের ডেকে বলে দিলেন, ফজরের নামাজ পড়ে ভোটারদের কেন্দ্রে কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে যেতে। নিজের ভোট দিয়ে বাকি সবাইকে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসতে। আমরা সংবাদকর্মীরা ঘুরতে ঘুরতে ভোট কেন্দ্রে দেখলাম হাওয়া মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুকূলে বইছে। যদিও আমি প্রথম দিনেই রিপোর্ট করেছিলাম, ‘গণরায় নেওয়া হয়ে গেছে তার’, ‘মহিউদ্দিনের পক্ষে গণজোয়ার’। নির্বাচনের শেষে হাজার হাজার নেতা-কর্মী নিয়ে কন্ট্রোল রুমের সামনে বসে থাকেন। কর্মীরা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে এলে হারিকেন হারিকেন স্লোগান তোলেন। ফল নিয়ে ঘরে ফেরেন। ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র হানিফ চেয়েছিলেন ‘মেট্রোপলিটন’ নামে আর মহিউদ্দিন চৌধুরী ‘সিটি গভর্নমেন্ট’। মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম থেকে গণতন্ত্রের আগুনের বারুদ জ্বলে উঠেছে বার বার। তার জীবনের সব অর্জন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া। চট্টগ্রামবাসীর স্বার্থ রক্ষায় তিনি কোনো কিছুই তোয়াক্কা করতেন না। আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা হৃদয় দিয়ে কার্যত তিনি হয়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রামের জননন্দিত নায়ক। একজন আল্লাহভীরু ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। হাজার হাজার মানুষকে হজ কাফেলায় নিয়ে গেছেন। তাদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। চিন্তা-ভাবনা-চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। চট্টগ্রামের ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সব মানুষকে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিতেন। চট্টগ্রামবাসী শত বছরে এমন নেতা গণমুখী সাহসী রাজনীতিবিদ পাবে কিনা সন্দেহ। নগর ভবনেও তিনি যখন বসতেন, শ দুয়েক মানুষের দুপুরের খাবার যেত বাড়ি থেকে। মানুষ নিয়ে চলতেন, মানুষ নিয়ে খেতেন। মানুষ নিয়ে ভাবতেন। তার মধ্যে কেউ কেউ লালুপ্রসাদ যাদবের ছায়া, কেউ কেউ মাহাথিরের মতো স্বাপ্নিক গুণাবলি দেখতেন। ডিসেম্বর এলেই তার নেতৃত্বে প্রতি বছর বিজয় মেলা হতো। প্রতি বছর বিজয়মঞ্চে অতিথি করে নিতেন আমাকে। আওয়ামী লীগের যারা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অঙ্গীকার লালন করতেন না, আমার বক্তৃতায় তাদের সমালোচনা করেছি। আমার বক্তৃতার পর মহিউদ্দিন চৌধুরী এ নিয়ে ব্যাখ্যা দিতেন, ‘পীর হাবিবুর রহমান আওয়ামী লীগ করেন না। এ মঞ্চ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবার জন্য উন্মুক্ত। সবার কথা বলার স্বাধীনতা আছে। তার বক্তব্যে কেউ দুঃখ পাবেন না।’ চট্টগ্রামের মানুষ অতিথিপরায়ণ। যতবার চট্টগ্রাম গিয়েছি, মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে একবেলা খেতে হয়েছে। সাবেক দুই মেয়র মীর নাছির ও মাহমুদুর রহমান চৌধুরীর বাড়িতেও আতিথেয়তা নিতে হয়েছে। নিতে হয় সাবেক চাকসু ভিপি আমাদের অগ্রজ বন্ধু নাজিম উদ্দিনের আতিথেয়তাও। মহিউদ্দিন চৌধুরী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত ছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনে কারা নির্যাতনকালে তার কন্যাকে ক্যান্সারে হারিয়েছেন। তবু তার নেত্রীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। কিন্তু তার প্রখর ব্যক্তিত্ব নিয়ে মত ও পথের অমিল থাকলেও সবার সঙ্গেই সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা করতে কার্পণ্য করেননি। তার এই মৃত্যুতে রাজনীতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণ হওয়ার নয়। বিজয়ের মাসেই বীরযোদ্ধা মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিদায় গৌরব ও সম্মানের।
লেখক : প্রধান সম্পাদক : পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ।
সূত্র : বিডি প্রতিদিন