১৯৭৭ সালের ৪ এপ্রিল। ঢাকার ইডেন হোটেলে কাউন্সিল অধিবেশন ডাকে আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতা হত্যার মধ্য দিয়ে দলটি তখন নেতৃত্বশূন্য। ওই কাউন্সিলে ৪৪ সদস্যবিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জোহরা তাজউদ্দীন। দলটির ক্রান্তিকালে হাল ধরেন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন। সূত্র: বণিক বার্তা
গত বছর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে দেশ থেকে পালিয়ে যান দলটির নয়বারের সভাপতি এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণহত্যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও এর নেতাদের বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগের এমন সংকটময় মুহূর্তে আবারো আলোচনায় তাজউদ্দীন পরিবার।
আশির দশকের মতো এবারো আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত) হাল ধরার জন্য তাজউদ্দীন পরিবারকে দলটির কর্মীরা ডাকছে বলে জানিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদ। তার ভাষ্যমতে, ‘আসলে যে আওয়ামী লীগ আমাদের বাবা করেছেন, সেটি ধ্বংস করে এখন করা হয়েছে পরিবার লীগ। সেটা দিয়ে তো নতুন করতে পারবে না। কিন্তু যারা সংস্কার চায়; আওয়ামী লীগ থেকে তো প্রচুর যোগাযোগ হচ্ছেই। আমাকে বলে দলের হাল ধরতে। তৃণমূল পর্যায়ে অনেকেই আছে যাদের বাবা-দাদা আওয়ামী লীগ করতেন। তারাও ভালোবেসে আওয়ামী লীগ করে। তাদের তো কোনো প্লাটফর্ম নেই। কিন্তু আমাদের কথা হচ্ছে, আমরা তো রাজনীতি করতে চাচ্ছি না। তাদের আমরা বলি, আপনারা যদি ভালো করেন তাহলে দেশবাসী সাপোর্ট করবে। কিন্তু আমাদের একজন এসে ঠিক করবে সেই অবস্থাটি তো নেই। এটি ভিন্ন এক পরিস্থিতি। আমার আম্মা যখন হাল ধরেছিলেন তখন পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল।’
তিনি আরো বলেন, আমি যখন বলি আপনারা নিজেরা করেন তখন তারা বলে, ‘আপা কাউকে তো পাচ্ছি না। আমরা তো অল্প কিছু লোক।’ আবার বলে যে, ‘আমরা তো সাহস করতে পারি না। অনেকেই হ্যাঁ বলে। কিন্তু পরে দেখা গেল যে যদি শেখ হাসিনা চলে আসে, এটিও তো ভয় পায় তারা।’
জোহরা তাজউদ্দীন কর্তৃক আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করার সিদ্ধান্ত স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশের ভিত্তিতে হঠাৎ নেয়া বলে জানান শারমিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘আমার মার কথাই ধরুন। উনি একটি মিটিংয়ে গিয়েছিলেন। সেই মিটিংয়ে কেউ কাউকে কনভেনার হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারছে না; কেউ কাউকে মানছে না। এর আগে আব্বাকে হত্যা করার পর আম্মা কখনো যেতেন না। আমার মনে আছে; মার্চের শেষের দিকে আম্মা একটা স্বপ্ন দেখলেন যে ‘আব্বু বলছেন, তুমি মিটিংয়ে যাও না কেন।’ তখনো আওয়ামী লীগের ঘরোয়া রাজনীতি চলছিল।
সে সময়ই আওয়ামী লীগের একটি ঘরোয়া সভার চিঠি আম্মা পেলেন। সভাটি হবে জহিরুল কাইয়ুম সাহেবের ধানমন্ডির বাসায়। পরে আম্মুর স্বপ্নের কথা মনে হলো। আম্মা গেলেন। ওইখানে যাওয়ার পর দেখলেন ২ ঘণ্টা, ৩ ঘণ্টা, ৪ ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কে হবে তা নিয়ে একজনকে নির্বাচিত করলে অন্য দল মানে না। তখন হঠাৎ করে জহিরুল কাইয়ুম সাহেব উপস্থাপন করলেন—‘আচ্ছা, ভাবি (জোহরা তাজউদ্দীন) হলে কেমন হয়?’ তখন সবাই এক হয়ে গেল। তখন আম্মা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তখন তো উনি প্রতীক ছিলেন। প্রত্যেকটি গ্রামে গিয়ে নেতাকর্মীকে উজ্জীবিত করেছেন, সাহস দিয়েছেন, আশা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের পুনর্জন্মটা আম্মার হাতে হলো।’
নিজের লক্ষ্যের বিষয়ে শারমিন আহমদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বলতে পারি আমার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নেই। কিন্তু আল্লাহ কখন কাকে দিয়ে কী করাবে ইউ নেভার নো। আমার কথা হচ্ছে, যে ক্ষেত্রেই থাকি না কেন আমার দ্বারা যেন মানুষের ক্ষতি না হয়। মানবসেবা যেন করে যেতে পারি।’
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন শারমিন আহমদ ও তানজিম আহমদ সোহেল তাজ। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলার সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতি নয় বরং মুক্তিযুদ্ধসহ চারটি বিষয়ে জোর দিয়েছেন বলে জানান শারমিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘আমরা ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের প্রধান কাজটা তো মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে। একই কথা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বলে এলাম। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, আহতদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, মুক্তিযুদ্ধ এবং শিক্ষা সংস্কারের বিষয়ে আমরা কথা বলেছি।’
গত বছরের ২৪ আগস্ট বাংলা একাডেমির সাহিত্যবিশারদ আব্দুল করিম মিলনায়তনে ‘শতাব্দীর কণ্ঠস্বর তাজউদ্দীন আহমদ: কন্যার চোখে, পুত্রের চোখে’ শীর্ষক এক আলোচনায় দেয়া বক্তব্যে তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে তানজিম আহমদ সোহেল তাজ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নেয়াবিষয়ক এক প্রশ্নে বিভিন্ন ‘শর্ত’ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘নির্দিষ্ট কিছু দায় আওয়ামী লীগ মেনে না নিলে এ দলের নেতৃত্বে আসার প্রশ্নই ওঠে না।’
আওয়ামী লীগের হাল তাজউদ্দীন পরিবার বা সোহেল তাজ ধরবেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দায়িত্ব তখনই নেয়ার প্রশ্ন আসবে, আওয়ামী লীগ সংগঠন হিসেবে যখন আত্মসমালোচনা শুরু করবে, আত্মোপলব্ধি করবে, তাদের কর্মকাণ্ডগুলো যখন স্বীকার করবে, যারা আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে তারা জবাবদিহি করবে। যারা হত্যা, গুম, খুনের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেবে এবং আওয়ামী লীগ যখন পরিষ্কার হবে, তারপর তারা যদি চায় আমি নেতৃত্বে আসি, তখন আমি বিবেচনা করব তার আগে নয়।’
তবে আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত) এক সাংগঠনিক সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ মুহূর্তে একমাত্র দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। প্রায় প্রতিদিন শেখ হাসিনা নিজে বিভিন্ন সাংগঠনিক ইউনিটের সঙ্গে মিটিং করছেন। আওয়ামী লীগ এর আগেও নানা ধরনের সংকটকাল পার করেছে। বর্তমানে যে সংকটে রয়েছে সেটি উত্তরণের লক্ষ্যে নানা ধরনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। অনেক সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।’