গোলাম মোর্তোজা: একটি রাজনৈতিক দল, যারা ক্ষমতায় থেকে অভ্যস্ত তাদের যখন ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয় তখন তাদের অবস্থাটা কী হয় বা একনাগারে অনেকদিন পর্যন্ত এই সমস্ত বড় দল যদি ক্ষমতায় যেতে না পারে, তাহলে তাদের নেতাকর্র্মীদের অবস্থাটা কী হয়। আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালের পর থেকে টানা ২১ বছর রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে ছিল। সেই সময় আওয়ামী লীগের অবস্থাটা কেমন ছিল। আওয়ামী লীগের সেই বিরোধী দলের ২১ বছর আর বিএনপির এই বিরোধী দলের ১৫ বা ১৭ বছর এর সঙ্গে কি কোনো তুলনা করা যায়?
বর্তমানে বিএনপি শিবিরে একধরনের হতাশা বিরাজ করছে। এই হাতাশাটা খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বিএনপি ধারণা করছে, তাদের বিপুল জনসমর্থন আছে। মানুষ যদি ভোট দিতে পারে অবশ্যই তাদের ভোট দেবে। একারণে বিএনপি একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছে। কিন্তু তাদের সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের যে আন্দোলন সেই আন্দোলনটি যে ২৮ অক্টোবর সমাবেশের মধ্যদিয়ে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে, এটা বিএনপির ভাবনায় ছিলো না। কিন্তু সরকারের নানা ধরনের ভাবনা ছিল। যদিও ২৮ তারিখের জনসভাটা বন্ধ করে দিয়ে তারা সকল নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে। এটা যদি ২৮ তারিখ না হতো তাহলে পরে কোনো একটা উপলক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একইরকমের কাজ করা হতো। কারণ তাদেরও ক্ষমতায় থাকতে হবে। আর বিএনপি শিবিরের যে হতাশা বিরাজ করছে তারা মুখে যাই বলুক বা না বলুক একই রকম আনন্দ বিরাজ করছে আওয়ামী লীগ শিবিরে। তাদের পক্ষে যেই দলগুলো আছে তাদের মধ্যেও আনন্দ বিরাজ করছে। সেই শিবিরের মধ্যে জাতীয় পার্টিও আছে।
বিএনপির এখন এমন হতাশ হওয়ার কারণ ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে তাদের সকল সম্ভাবনা ছিল কিন্তু সেই সম্ভাবনাটা এবারও আর থাকলো বলে মনে হয় না। ৭ জানুয়ারি একটি নির্বাচন হবে এবং সেই নির্বাচনটিতে যেহেতু বিএনপি অংশ নিচ্ছে না সেহেতু বিএনপির জেতারও আর কোনো সম্ভাবনা রইলো না। এখন বিএনপি কী মনে করছে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হবে না? আমার মনে হয় না বিএনপির কোনো নেতা এখন আর সেটা মনে করছে। আঞ্চলিক বাস্তবতা, আন্তার্জাতিক বাস্তবতা কোনো বাস্তবতাই এমন নয় যে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হবে না। ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচনটি হবে সেটি একটা একক ব্যবস্থাপনার নির্বাচন। এটি ঠিক ভোটের নির্বাচন নয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। আওয়ামী লীগের জন্য এখন কঠিন বিষয় হলো ২৯৮ আসনে তারা যে মনোনয়ন দাখিল করেছে তাদের পক্ষে সবচেয়ে কম আসন কয়টা পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ কয়টি আসন তাদের পক্ষে ছাড়া সম্ভব। আওয়ামী লীগ চাইলেই ২৯৮ আসনেই বিজয়ী হতে পারে। কারণ তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
আওয়ামী লীগের যারা নিজেদের এখন সর্বেসর্বা মনে করছেন, যারা ভাবছেন আওয়ামী লীগ সারাজীবন এমনই ছিল তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, ১৯৭৫ সালের পর আওয়ামী লীগ একটি ভয়ঙ্কর কঠিন সময় অতিক্রম করেছে। সামরিক শাসকরা তখন দেশ পরিচালনায় এসেছিল। ৭৫-এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পরে আওয়ামী লীগ একেবারে তছনছ হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কে দেবে, নেতৃত্বের ভেতর যে বিরোধ, একজনের আরেক জনের প্রতি অবিশ্বাস বেশ কয়েকবার দল ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। অনেক বড় বড় নেতা দল ভেঙে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। জাসদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে। একবার জাসদ আওয়ামী লীগকে মেরেছে, আরেকবার আওয়ামী লীগ জাসদকে মেরেছে। জাসদের ভয়ে একটা লম্বা সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তটস্ত ছিল। ইতিহাস কেউ পড়তে চাইলে পড়ে নিতে পারেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছ থেকেও জেনে নিতে পারেন। এভাবে বারবার আওয়ামী লীগ ভাঙার পরিপ্রেক্ষিতে তারা একটা বড় জনসমাবেশ করতে পারবে কি পারবে না সেটা নিয়েও তাদের একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকতে হয়েছে।
এরশাদ বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক, রশিদদের দেশে এনে ফ্রিডম পার্টি তৈরি করলো। তখন সেই ফ্রিডম পার্টির আতঙ্কে থাকতো আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তারা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ করতো। অনেকে ফ্রিডম পার্টির আক্রমণে মারাও গেছে। ওই সময়টিতে দৈনিক বাংলার উল্টোদিকে ক্যাফে ঝিল নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল সম্ভবত সেই রেস্টুরেন্টের আশেপাশে কোনো একটি নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ সেখানে একটি নৌকা লাগিয়েছিল। আওয়ামী লীগের সেই নৌকার প্রতীকের উপর ফ্রিডম পার্টির প্রতীক ছিল চাইনিজ কুড়াল। আওয়ামী লীগের তখন তেমন কোনো নেতা ছিল না যে সেই কুড়ালটি সেখান থেকে সড়িয়ে নৌকাকে ক্ষতবিক্ষত হওয়া থেকে রক্ষা করে। তার মানে হলো আজকে যারা আওয়ামী লীগ তারা যদি মনে করে থাকে যে সবসময় তাদের অবস্থা এমনই ছিল তাহলে ব্যাপরটি মোটেই তা নয়। দীর্ঘ ২১ বছর আওয়ামী লীগ আন্দোলন, ত্যাগ, মার খাওয়া, মারা যাওয়া বহু কিছু করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। তার পর থেকে আওয়ামী লীগ সংগঠিত হয়। ২০০৯ সালেও তারা জনগণের ভোটে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিল কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ভোট ছাড়া এবং ২০২৪ সালেও একই ঘটনা।
এই কথাগুলো বলার কারণ হলো বিএনপি নেতাকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দেয়া। বিএনপিও ক্ষমতায় থেকে অভ্যস্ত। এরশাদের সময় ৯ বছর ক্ষমতায় ছিল তারপর ৯১ সালে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছে, ৯৬ সালে পরাজিত হয়েছে, ২০০১ সালে আবার বিজয়ী হয়েছে, ২০০৯ সালে আবার পরাজিত হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকলে তারা আবার একবার বা দু’বার ক্ষমতায় আসতো। কিন্তু এখন তারা টাকা ১৫ বা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে। এই সময়ে বিএনপির কথা চিন্তা করলে দেখা যায় বিএনপির ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন, জেল, গুম, খুন ইত্যাদি আওয়ামী লীগের ওপর যতোটা হয়েছিল তারচেয়ে বেশি ছাড়া কম হয়নি। পুলিশি নিপীড়ন বা গুলি করার ব্যাপারগুলো এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় এতোটা ছিল না গত ১৫ বছরে যতটা দেখা গেছে। এতো মামলা কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ছিল না। এখনও ৪৯ বা ৫০ লাখ মামলা আছে। গায়েবী মামলা, গুজব মামলা, ভৌতিক মামলা আগে কখনো ছিল না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থেকে ২১ বছরে বারবার ভেঙেছে। কিন্তু বিএনপি ভাঙেনি। এখনোও এতো চেষ্টা চলছে তাও বিএনপি ভাঙেনি। যদিও শাহজাহান ওমর দল থেকে বের হয়ে অন্য দলে গিয়েছে কিন্তু অন্য নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করেনি। সেই অর্থে একে দল ভাঙা বলেনা। তার চলে যাওয়ায় বিএনপির কোনো ক্ষতি হয়েছে এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই। এই যে বিএনপি এখনও ভাঙলো না এবং শক্ত একটি অবস্থানে থাকলো আমার মনে হয় বিএনপির নেতাদের এখন দৃষ্টি দেওয়া উচিত যে ক্ষমতার বাইরে থাকা মানেই সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়। রাজনীতি করার একমাত্র উদ্দেশ্য এটা নয় যে সারাক্ষণ ক্ষমতা বা অর্থ-বিত্তের মধ্যে থাকতে হবে। বিরোধী দলে থাকলে দল কত শক্তিশালী হয় বিএনপি এখন তার প্রমাণ। বিএনপির নেতাকর্মীরা কখনো চিন্তা করেনি যে বিএনপির নেতারা জনসভার দুই-তিন দিন আগে জনসভার জায়গায় চট বিছিয়ে ঘুমিয়ে থাকবে। সকল যানবাহন বন্ধ করে দেয়ার পরেও লাখ লাখ মানুষ জনসভায় উপস্থিত হবে এটা বিএনপির কাছেও অকল্পনীয়। জন্মের পর থেকে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বিএনপি এখন শক্তিশালী। যারা বলছে বিএনপি বিলীন হয়ে যাবে তারা বিএনপির শক্তি দেখে ভয়ে এটা বলছে। এভাবে আরও কয়েকটি বছর তাদের কাটাতে হবে। নিশ্চয়ই এই দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসবে এবং তারা ভোট পাবে। জনগণ যদি ভোট দেয় তারা ক্ষমতায়ও আসতে পারে।
এখন নির্বাচন হচ্ছে না, একটি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা হচ্ছে। একজন সেটার ব্যবস্থাপনা করছে। জাতীয় পার্টি দ্বারে দ্বারে ঘুরছে আসনের জন্য। জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব এই নির্বাচন থেকে প্রায় বিলীন হয়ে যাবে। জাতীয় পার্টি যে আঞ্চলিক দল ছিল সেটাও আর থাকবে না। সেখানেও গ্রুপিং হবে। দেবর-ভাবীর গ্রুপিং, রংপুরের নেতাদের গ্রুপিং। তৈমুর আলম খান, শমসের মবিন চৌধুরী ইতিহাসে এদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। অন্যান্য ইসলামি যে দলগুলো আছে যারা সুবিধা নেয়ার জন্য গেছে এগুলোর অস্তিত্ব এমনিতেই নেই। তারমানে হলো একক ব্যবস্থাপনার একটি নির্বাচন হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনও সেভাবে সহায়তা করে একটি নির্বাচনের আয়োজন করছে। তবে এগুলো দেখে বিএনপির হতাশ হবার কোনো কারণ আমি দেখি না। কারণ তারা একটি শক্তিশালী দলে পরিণত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও হবে। পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক। সূত্র : ‘গোলাম মোর্তোজা’র ফেসবুক পেইজের ভিডিও কন্টেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস