ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: ক’দিন আগে আপনাকে ৭৭ তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছি। আপনি বঙ্গবন্ধুকন্যা, আপনার ধমনীতে প্রবাহিত বঙ্গবন্ধুর রক্ত। কাজেই আপনাকে দেখলেই যেন বঙ্গবন্ধুকে দেখা হয়। বঙ্গবন্ধুকে মর্মন্তুদভাবে হারিয়ে আপনারে পেয়েছি। কাজেই আপনার আয়ুকালীন আপনাকে হারাতে চাই না। নিজের কর্ম-কৃতি দিয়ে আপনি দেশ ও জনগণকে অনেক সমৃদ্ধ করেছেন। আশা রাখি, আগামীতে আপনার নেতৃত্ব ও দিগ্দর্শন থেকে আমরা আরও সমৃদ্ধির স্পর্শ পাবো। সঙ্গত কারণে আপনার কাছে প্রত্যাশা অনেক। জানি প্রত্যাশা-প্রাপ্তির সমীকরণ কোনো জীবনেই হয় না। তবুও মন তো মানে না। যাকে নিকটতম ভাবি, তার কাছে প্রত্যাশা অনেক হওয়াই স্বাভাবিক। জানি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক; ইতিহাস তাই বলে। তবুও তিনি নিভৃতে আপন মনে গুন গুন করে গাইবেন, ‘মা আমার সাধ না মিটিল/আশা না পুরিল।’ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্জিত হলেও দেশটিকে সোনার বাংলা তিনি করতে পারেননি; যদিও লাগসই প্রক্রিয়ার সূচনা তিনিই করেছিলেন। ঘাতকের বুলেট তাঁর জীবন কেড়ে নেওয়ায় তাঁর জীবন ও কর্ম দুটোই অসমাপ্ত থেকে যায়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূর্ণ রূপায়নের ব্রতে আপনি নিবেদিতপ্রাণ কর্মী; আমাদের স্বপ্নসারথি। কাজেই আপনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক।
প্রত্যাশা এক : আপনি ১৯৮১-র ১৭ মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বেঁচেছে, আমরাও বেঁচেছি, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ফিরে পেয়েছি। সাধে কী আর কবি হাসান হাফিজুর রহমান আপনাকে বলেছিলেন, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ।’ তিনি যথার্থ বলেছিলেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে আপনার তো অনেকদিন হয়ে গেলো। আপনি মহীরুহ হয়েছেন, কিন্তু চারাগাছ জন্মাতে দেননি (বা জন্মায়নি)। আপনার অবর্তমানে আওয়ামী লীগের হাল ধরবে কে? এটা জানার ঔসুক্য আছে, কারণ আওয়ামী লীগ দেশের বৃহত্তম ও তৃণমূললগ্ন দল এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল। কাজেই আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক হোক, এটা আমরা চাই। দলটির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল হতে চাই। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ তে সভাপতি হয়ে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সারির নেতৃত্ব তৈরি করেছিলেন। দ্বিতীয় সারির চার জাতীয় নেতার কারণে সংক্ষিপ্ততম মুক্তিযুদ্ধ সফলভাবে পরিচালিত হয়েছিল। তৃতীয় সারির নেতা ছিলেন ‘চার খলিফা’Ñ চার ছাত্রনেতা। নেতার কাজ শুধু নেতৃত্ব দেওয়া নয়, নেতা তৈরি করাও।
প্রত্যাশা দুই : গণতন্ত্রে দল ও সরকার এক থাকে না; ভারতেও নয়। দল ও সরকার এক থাকলে ব্যবস্থাপনা শাস্ত্র অনুযায়ী কোনোটিই ভালো চলে না। ১৯৫৭-তে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে দলের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ১৯৭৪-এ কামারুজ্জামানকে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি করেছিলেন।
প্রত্যাশা তিন : বাজার ব্যবস্থপনার অভাবে গরিব মানুষ কষ্টে আছে। তাদের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরায়। অথচ সংবিধানের ৭(১) ধারায় বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ সকল ক্ষমতার মালিকের বিত্ত-অভাবী মানুষের এ অবস্থা কাম্য নয়। বাজারে পণ্যমূল্য বাড়লে আমদানি করা হয়, যার প্রভাব যে বাজারে পড়ে না, সে কথা মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন। পণ্যমূল্য বাড়ে সিন্ডিকেটের কারণে; অথচ সিন্ডিকেট থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র আছে; সিন্ডিকেট যার অংশ। সিন্ডিকেট সামলান, বাজারে স্বস্তি ফিরবে। প্রশাসনের বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত সীমিত বিত্তের মানুষের পেটে আর পকেটে স্বস্তি দেওয়া, যা হয়ে উঠছে না বাজার পরিস্থিতির কারণে। মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো কে.এস. লাল এর বই দ্য প্রাইস কন্ট্রোল সিস্টেম অব আলাউদ্দীন খলজী বইটি পড়তে। দিল্লির সুলতান আলাউদ্দীন খলজী (১২৯৬-১৩১৬) কীভাবে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, তার আলোচনা আছে বইটিতে। সে সময়ের পরিবেশ আর এখনকার পরিবেশের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ, কিন্তু পদ্ধতি জানতে দোষ নেই।
প্রত্যাশা চার : আপনি ঘোষণা দিয়েছেন স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য; আমরাও সহমত। কিন্তু রাজপথে নামলে মনে হয়, স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য দিল্লি দূর অস্ত! রাস্তায় ব্যয়বহুল এবং অকেজো সিগনাল বাতি আছে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে; ট্রাফিক পুলিশের হাত ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, যা যানজটের প্রধান কারণ; অবশ্য সেনানিবাসে সিগনাল বাতি যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে, কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। অর্থাৎ এক শহরের মধ্যে দুই শহর! ফলে সেনানিবাসের বাইরে আধ ঘণ্টার পথ আমরা পাড়ি দিই দু’ঘণ্টায়। যানজট নিরসনে আপনার উদ্যোগ ও কর্মের কমতি নেই। কিন্তু কাজ কতোটুকু হলো?
আমাদের প্রত্যাশা হিমাদ্রিসম; কিন্তু আপনার সাধ্য সীমিত, তা আমরা জানি। আমরা এটাও জানি, বঙ্গবন্ধু-কন্যা হিসেবে আপনার সাধের ঘাটতি নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আপনাকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রত্যাশার কমতি নেই। আপনি আমাদের সব প্রত্যাশার কেন্দ্রে আছেন।
লেখক : চেয়ার অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)