মাসুদ রানা: সত্য কোনো বস্তু নয়। মিথ্যাও কোনো বস্তু নয়। সত্য-মিথ্যা বলে কোনো বস্তু বস্তুজগতে নেই। সত্য ও মিথ্যা হচ্ছে আমাদের বিবৃতির বৈশিষ্ট্য। কী বৈশিষ্ট্য? আমাদের বিবৃতির সাথে বিবৃতিতে নির্দেশিত বস্তু, ঘটনা বা বিষয়ের অভিন্নতা কিংবা ভিন্নতা। অর্থাৎ, অস্তিত্বের স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতিই সত্য-মিথ্যা। আমি যদি বলি ‘লোহা জলে ভাসে’, আমার এ-বিবৃতি সত্য হতে পারে কিংবা মিথ্যা হতেও পারে। আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না ‘লোহা জলে ভাসে’ সত্য না মিথ্যা, যতোক্ষণ না পর্যন্ত আমি বস্তু ও ঘটনা প্রদর্শন করে বিবৃতির সাথে এর অভিন্নতা প্রমাণ করতে পারি।
আমি একটি লোহার টুকরো এক বাটি জলে ছেড়ে দিলাম। আমরা সবাই দেখলাম লোহার টুকরোটি ভাসলো না, ডুবে গেলো। সুতরাং ‘লোহা জলে ভাসে’ সত্য প্রমাণিত না হয়ে মিথ্যা প্রমাণিত হলো। এখন আমাদের কাছে সত্য হচ্ছে ‘লোহা জলে ভাসে না’। আর মিথ্যা হচ্ছে ‘লোহা জলে ভাসে’। কিন্তু সত্য-মিথ্যা স্থির নয়। আসলে, যার অস্তিত্ব আছে, তার স্থিরতা নেই। কারণ, গতি ছাড়া অস্তিত্ব হয় না, আর অস্তিত্ব ছাড়াও গতি হয় না। প্রতিটি গতির একটি পরিণতি আছে।
যাহোক, আমাদের সত্য ও মিথ্যাও স্থির নয়। কারণ, এগুলো নির্ভর করে পুনরায় বস্তু, ঘটনা ও বিষয়ের ওপর। উপরে উপস্থাপিত ‘লোহা জলে ভাসে’ বিবৃতিটি আমি সত্য প্রমাণ করতে পারিনি। মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এটি কি চিরন্তন? লোহা কি কখনও কোনো পরিস্থিতিতেই জলে ভাসে না? এবার ঘটনার পরিবর্তন করে দেখা যাক। আমি লোহার টুকরোটিকে গরম করে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে খুবই পাতলা ও চ্যাপ্টা করলাম এবং এর ফলে এটি একটি বড়ো আকার ধারণ করলো। এখন আমি এর সমগ্র কিনারা প্ল্যায়ার্স দিয়ে চেপে ভেতরের দিকে টেনে একটি উচ্চতায় খাড়া করে দিলাম। তাতে লোহার টুকরোটি একটি জাহাজের খোলের মতো লাগছে।
এবার আমি সেই লোহাকে জাহাজের মতো তলটিকে জলে স্থাপন করলাম। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, লোহাটি আগের মতো জলে ডুবে যায়নি বরং ভাসছে, যেমন জাহাজ ভাসে! তো, আমার আগের মিথ্যা প্রমাণিত ‘লোহা জলে ভাসে’ আর মিথ্যা থাকলো না। সে-মিথ্যা স্বয়ং মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে সত্য হয়ে গেলো। এখন আমরা দেখছি, লোহা জলে ভাসে। দেখা যাচ্ছে, ‘লোহা জলে ভাসে’ এক পরিস্থিতিতে মিথ্যা কিন্তু অন্য পরিস্থিতিতে সত্য। এখন কি আমরা কনফিউড হয়ে গেলাম না? আমরা কি বলবো ‘লোহা জলে ভাসে’ সত্য ও মিথ্যা? এটি কীভাবে সম্ভব? দেখলামতো সম্ভব।
আসলে, আমাদের বুঝতে হবে, ‘লোহা জলে ভাসে’ এক শর্ত সাপেক্ষে মিথ্যা, আবার অন্য শর্ত সাপেক্ষে সত্য। অর্থাৎ চির সত্য বলে কিছু নেই। কারণ সত্য অস্তিত্বের বা অনস্তিত্বের সঠিক বিবৃতি, কিন্তু অস্তিত্ব স্বয়ং পরিবর্তনশীল বলে এর সম্পর্কে স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতি স্থির নয়, তাই সত্যও স্থির নয়। এই সত্য-মিথ্যার অস্থিরতা তার সম্পর্কে উচ্চতর বোধ গড়ে তুলতে হলে ঘটনার গভীরে যেতে হবে। এরূপ যাওয়ার জ্ঞানই হচ্ছে দর্শন ও বিজ্ঞান।
দর্শন আমাদের বস্তু, ঘটনা ও বিষয় সম্পর্কে ভাবায়, কল্পায়, যাচাইয়ে উদ্বুদ্ধ করে। বিজ্ঞান আমাদেরকে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের পদ্ধতি দেয়। ‘লোহা জলে ভাসে’ সত্য হয় কেনো কিংবা মিথ্যা হয় কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে ও কোন প্রক্রিয়ায় তথা কোন বা কোন-কোন শর্তে, সেটির পর্যবেক্ষণ, কল্পন, পরীক্ষণ, প্রদর্শন ও সাধারণীকরণই বিজ্ঞানের পদ্ধতি। সত্য-মিথ্যার প্রশ্নে আজ এখানেই থামি। পরবর্তী সময়ে এখান থেকে আলোচনা শুরু করবো বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের পদ্ধতি নিয়ে। লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড