ইমতিয়াজ মাহমুদ: ভারতের মেয়েরা একদিবসীয় খেলাটির জন্য জনপ্রতি প্রায় আট লাখ টাকা করে পাবে। এটা ওদের বোর্ডের নির্ধারিত ম্যাচ ফি, জয়-পরাজয় যাই হোক, প্রতি ম্যাচ খেলার জন্যে প্রতি খেলোয়াড়, নারী বা পুরুষ যাইই হোক, ভারতীয় মুদ্রায় ছয় লাখ টাকা (বাংলাদেশ মুদ্রায় আট লাখ টাকার চেয়ে সামান্য কিছু কম) করে পাবে ম্যাচ ফি হিসাবে। লক্ষ্য করুন, এই ফি কিন্তু নারী ও পুরুষের জন্য সমান। ভারতের বোর্ড সম্প্রতি নারী-পুরুষের মধ্যে ম্যাচ ফির বৈষম্য বিলোপ করেছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা কতো করে পাবেন? সঠিক অংকটা আমি জানি না, সম্প্রতি কোনো একটা কাগজে দেখেছিলাম যে, এখন থেকে প্রতিটি একদিনের খেলার জন্যে বাংলাদেশের মেয়েরা পাবে বাংলাদেশি তাকায় এক লাখ টাকা করে। না, ভারতের খেলোয়াড়দের চেয়ে আমাদের খেলোয়াড়রা একটু কম ফি পাবেন, সেটা নিয়ে আমি প্রশ্ন করি না। যেটা আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, সেটা হচ্ছে যে, আমাদের মেয়েরা আমাদের ছেলেদের চেয়ে কমবেশি এক তৃতীয়াংশের মতো ম্যাচ ফি পায়।
এই ম্যাচ ফিটা ছাড়াও বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ পুরুষ খেলোয়াড়রা বার্ষিক একটা বেতন পায়। মেয়েদের জন্যে এরকম চুক্তির ব্যবস্থা আছে কি না জানি না, যদি থাকেও তাইলে সেখানে দেখবেন যে মেয়েদের বেতন হবে পুরুষদের তুলনায় অতি তুচ্ছ। আর আমরা যে মেয়েদের খেলার কি রকম গুরুত্ব দিচ্ছি সেটা তো আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন। মেয়েদের খেলা কোনো টেলিভিশনে দেখানো হয় না, ওদের দলের জন্যে কোনো স্পসর নেই, স্পন্সর জোগাড় করার জন্যে বোর্ডের কোনো চেষ্টাও আমরা দেখি না। নিতান্ত একটা দল রাখতে হয় বলেই যেন মেয়েদের একটা দল রেখেছে। এর আগেও বলেছি, সরকারি চার পাঁচটা চ্যানেল আছে বিটিভির। নানা রকম বিচিত্র জিনিস দেখানো হয় এইসব চ্যানেলে। একটা চ্যানেলে যদি আমাদের মেয়েদের খেলা দেখানো হতো, আমরা কিছু স্পন্সর হয়তো পেতাম।
সরকার এবং বোর্ডের এইরকম অবহেলা ও আপনাদের সকলের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের বিপরীতে আমাদের মেয়েদের ত্যাগ, নিষ্ঠা ও সংগ্রামের গল্পগুলো যদি শোনেন, তাহলে ওদের জন্যে গর্বে আপনার বুক ফুলে উঠবে। মাথা নত করে সেলাম করবেন আপনি। যে মেয়েটা চার চারটি ভারতীয় উইকেট নিয়ে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছে, এই মেয়েটাকে কি আপনি চেনেন? মারুফা এই মেয়েটার নাম। মারুফা একজন দরিদ্র কৃষকের মেয়ে। বাবার সঙ্গে জমিতে হাল চালাত মেয়েটা। ওর পরিবার কখনো চায়নি সে ক্রিকেট খেলুক। সমাজ থেকে বাধা এসেছে প্রতি পদে পদে। পরিবারের ও সমাজের বাধা উপেক্ষা করে খেলতে এসেছে। ক্রিকেটের প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকেই এসেছে। দ্রুত গতিতে বল করে, দেখা গেলো যে মারুফা চমৎকার সুইং করাতে পারে। খেলার শেষে প্রেসের সঙ্গে ওদের কথা থেকে জানা গেলো মারুফা যে এইরকম চমৎকার সুইং করাতে পারে সেকথা নাকি মারুফা নিজেও জানতো না।
না, ভারতের সঙ্গে এর আগে আমাদের মেয়েরা কোনো একদিনের খেলায় জিততে পারেনি। এটাই প্রথম জয়। দেখেন, এই খেলাটা কিন্তু ভারত বাংলাদেশ খেলা, সেই দুই পতাকা, লাল সবুজ আর তেরঙ্গা। আপনি নিজেই বলুন, এই খেলাটা যদি পুরুষদের ক্রিকেট হতো, তাহলে যে পরিমাণ প্রশংসা ও উচ্ছ্বাস ইত্যাদি আপনারা দেখাতেন, তার তুলনায় এই খেলায় কিছু করেছেন? কী ঘোড়ার ডিম করেছেন! খেলাগুলো কোনো টেলিভিশনে দেখাচ্ছে না, এই খেলার জন্য কোনো টিকেট নেই, ফ্রি, তবুও কতোজন দর্শক গিয়েছেন স্টেডিয়ামে। শোনেন, এই যে অবহেলা এর পুরোটাই কি মনে করেন মেয়েদের দক্ষতা কম বলে করা হয়? জি না জনাব। আমাদের সমাজে একটা বিদ্যমান মিসোজিনি আছে। মেয়েদের আমরা এমনিতেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করি। আর খেলাধুলায় মেয়েদের অংশ নেওয়ার বিরুদ্ধে যে একটা প্রবল শক্তি আছে সেকথা তো আমরা জানি। মেয়দের ক্রিকেটের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য নিতান্তই মিসোজিনির প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়।
আমাদের দলের ক্যাপ্টেন কী বলেছেন, শুনেছেন? তিনি কিন্তু ঠিকই বলে গেছেন যে ওরা লড়াই অব্যাহত রাখবে। ভারতের মেয়েদের বিপক্ষে যেমন একটা ইতিহাস তৈরি হয়েছে, এরকম ইতিহাস ওরা ঠিকই তৈরি করে যাবে। আপনারা যে গুরুত্ব দিবেন না, আপনারা যে বৈষম্য করবেন সেকথা ওরা জানে। সবকিছু জেনেই ওরা ওদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। আমাদের এই সংগ্রামী কন্যাদের সবাইকে, সবাইকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
লেখক: আইনজীবী। ফেসবুক থেকে