ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি খুব স্বস্তিদায়ক নয়। নয় মাস ধরে নন রেসিডেন্সিদের ভাতা না পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশাক্ষনার্থী চিকিৎসকরা সংক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে আমাদের ডাক্তারদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন খুব কঠিন একটা জার্নি। আর্থিক টানাপোড়েন এই জার্নিকে আরো কঠিন করে ফেলেছে। আমি মাত্র পাঁচ বছর আগেও এই জার্নির একজন যন্ত্রণাক্লিষ্ট যাত্রী ছিলাম।
পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার সময় অবস্থা দাঁড়ায় শ্যাম রাখি না কূল রাখি৷ আমি ছিলাম আমার পরিবারের কাছে তুরুপের তাশ। স্কুল কলেজে ভাল ফলাফলের কারণে আমাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতেন বেশি৷ কিন্তু এমবিবিএস পাশ করার একযুগ পরও আমি কাংক্ষিত প্রতিষ্ঠা ও আর্থিক স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে পারিনি। পেশাগত ক্ষেত্রে তেমন সম্ভাবনাও দেখাতে পারিনি। আমার প্রত্যাশা কিছু ছিলনা। স্রেফ নিজের প্রয়োজন মিটিয়েও যেন শখ পূরণের জন্য কিছু উদবৃত্ত থাকে সেটাই ছিল প্রত্যাশা। খুব বেশি হলে নিজের একটা ঠিকানা৷
কিন্তু অবস্থা দাঁড়ালো এমন যে আমি বেতন যা পাই তা দিয়ে এ ঢাকা শহরে কেবল বাসা ভাড়াটা চলে। বাকি টাকা উপার্জন করতে আমাকে বাড়তি কাজ করতে হয়। পার্ট টাইম জব করলে হাতে আবার সময় থাকেনা। পড়ব কখন?
এমবিবিএস পাশ করার তৃতীয় বছরে আমি ঢাকায় আসি। প্রথমবারের মত পোস্ট গ্রাজুয়েশনে পরীক্ষা দেই এবং একটি নন রেসিডেন্সি কোর্সে চান্স পাই। আমি বিসিএস এর আগে কোন কোর্সে যেতেও চাইনি। কারণ আমি জানি আমার অবস্থা৷ কিন্তু বিসিএসটা ঝুলে গেল ওয়ান এলিভেনের টারময়েলে। ফলে কোর্সে না ঢুকলে "কিছুই তো হলোনা" এই অনুভুতি তীব্র হয়ে উঠছিল।
আপনাদের বলে রাখি, আগে কখনো এভাবে বলিনি- আর্থিক টানাপোড়েন, হ্যাঁ স্রেফ আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে দুই হাজার আট সালে একটা কোর্সে ঢুকেও আমি সেটা শেষ করতে পারিনি। এই ঢাকা শহরে টিকে থাকার জন্য আমাকে একটা জব করতে হতো যেটা করে আমি পড়াশুনার জন্য কোন সময় পেতাম না। আমার সে সময়ের কোর্স মেটরা স্বাক্ষী আমি এক প্রায়ভেট হাসপাতালের খালি চেম্বারে দরজা আটকে পরীক্ষার আগের দিন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু এভাবে তো হয়না। আমার আসলে উপায়ও ছিলনা। নিজের কথা ছাড়াও আমাকে ভাবতে হয়েছে আমার স্ত্রী, পুত্র, বাবা মার কথা৷ ঐ চাকরিটা ছাড়লে এই ঢাকা শহরে আমার বাবা মা কে নিয়ে আমি টিকতে পারতাম না৷
এরপর আমি সেই কোর্স থেকে একপ্রকার বের হয়ে যাই৷ কারণ পাশ করতে পারছিলাম না৷ বিভাগ থেকেও আমি কোন সহযোগিতা পাইনি। সামান্য সহযোগিতাও না। বিভাগের কোন শিক্ষক কোনদিন জানতে চাননি আমার কি হয়েছে? আমি টাকা পয়সা চাইনি কারো কাছে৷ কোন ভাতা টাতাও না৷ কেউ আমাকে পাশ করিয়ে দিক তাও চাইনি। আমি শুধু চেয়েছিলাম আমার কোন শিক্ষক আমাকে ডেকে বলুক " তোমার কি সমস্যা গুলজার? কেন পারছোনা?"
আমি নিজেকে খুব ভাল জানি। আমার আত্মবিশ্বাস ভয়াবহ৷ আমি জানি দিন একদিন আমার আসবে৷ আমি লম্বা রেসের ঘোড়া৷ অনেকটা অভিমান করে বায়ো স্ট্যাটিস্টিক্স চতুর্থবার ফেল করে আমি বিভাগে গিয়ে কোর্স উইথড্র করার জন্য এপ্লিকেশন করি। আমার আরো পরীক্ষা দেবার সুযোগ ছিল। নিতে ইচ্ছে করেনি। ঐ বিভাগে আর ফিরতেও ইচ্ছে করেনি৷
এমবিবিএস পাশ করার পর আজ অবধি আমি আমার জীবনে একটা দিনও চাকরি ছাড়া থাকিনি। আমার সে সুযোগ হয়নি। সবাই এমনভাবে জব করত যেন সপ্তাহে দুই দিন বা এক দিন কাজ করে বাকি পাচ ছয়দিন পুরোটা সময় লাইব্রেরিতে দিত। পরীক্ষার আগে আগে সেই চাকরিটাও ছেড়ে দিত । আমার সে সুযোগ কোন দিন হয়নি। একটু বেশি টাকা রোজগারের জন্য আমি এডমিনে কাজ করতাম। একটা দিনও আমার অফ দেবার উপায় ছিলনা। হাসপাতালটা ছিল গ্রোয়িং ফেইজে।
এরপর আমার বিসিএস হলো। এক দিক থেকে বেঁচে গেলাম আরেকদিক থেকে পড়লাম নতুন বিপদে। সেই গল্প থাক। উপজেলায় যেতে হলো। পড়াশুনা মাথায়। আমি বার বার ফেইল আর সহ্য করতে পারছিলাম না। বিরতি নিলাম। আয় রোজগার করলাম। স্ত্রী পোস্ট গ্রাজুয়েশন পাশ করল, বিশেষজ্ঞ হলো। এমবিবিএস পাশ করার সাত বছরের মাথায় আমি আবার এমডি রেসিডেন্সি কোর্সে পরীক্ষা দিলাম। এবার অন্য একটি বিভাগে৷ আগের বিভাগে আর ফিরতে মন চাইলোনা৷
এর পরের জার্নিটাও আগের মত কঠিন না হলেও কম কঠিন ছিলনা৷ আমার স্ত্রী ততদিনে বিশেষজ্ঞ হওয়াতে আমার চাপ কিছুটা কমেছে কিন্তু খুব বেশি কমেনি৷ কারণ এই ঢাকা শহরে বেসরকারি খাতে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের রোজগার সামান্যই। আমার স্ত্রী একজন বেসরকারি চিকিৎসক।
ছেলে বড় হতে থাকে। বাবা মায়ের চিকিৎসা ব্যয় বাড়তে থাকে৷ বাসাভাড়া বাড়ে। মূদ্রাস্ফীতি বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। আমাদের রোজগার বাড়ে কচ্ছপের গতিতে। লুকিয়ে একটা পার্টটাইম জব করতাম কিন্তু সেখানেও ঠিকভাবে সময় দিতে পারতাম না বলে কর্তৃপক্ষের সাথে খটমটি লেগেই থাকত।
এভাবেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকলাম কয়েকটা বছর। পরিবারের লোকজন, আত্নীয়স্বজনের নানারকম কথা উপেক্ষা করে, কানে তুলা দিয়ে কাটিয়ে দিলাম। সকালে বের হতাম রাত সাড়ে এগারটায় ঘরে ফিরতাম। ছেলেকে কোন কোন দিন জাগ্রত পেতাম, কোনদিন তাও পেতাম না৷ এভাবেই কাটলো।
এসব কিছুই আসলে আমার কাছে কিছুনা। মানসিকভাবে আমি খুব সুখী একজন মানুষ। অমানুষের মত খাটতে পারি চাইলে। টানা চৌদ্দ ঘন্টা কাজ করে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাসায় ফিরতে পারি। এসে হারমোনিয়াম নিয়েও বসতে পারি৷
কিন্তু যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি তাড়া করত সেটা হলো পরীক্ষার চাপ আর ফেইলের ভয়৷ আর চারপাশের সহানুভূতির অভাব।
এই গল্পের সমাপ্তি ঘটলো এক সময়।
আমি ফুলে ফসলে ভরে উঠলাম তা নয়। নিষ্কৃতি পেলাম অন্তত মানসিক চাপ থেকে। দরকারি খরচ যুগিয়েও কিছু শখের খরচ আর সামান্য সঞ্চয়ের ব্যাবস্থা হলো। এই জীবনে আর কিছু তো চাইনি।
আমার জীবনে তেমন কোন দু:খ নেই। শুধু একটাই দু:খ মাঝে মাঝে তাড়া করে। ২০০৮ সালের ঐ কোর্স টা আম যথাসময়ে শেষ করতে পারতাম তাহলে আজকে আমি পেশাগত ভাবে আরো অনেকদুর এগিয়ে থাকতে পারতাম। খুব অল্প বয়সে বিশেষজ্ঞ হয়ে পফ পদবীতেও এগিয়ে থাকতাম। সরকারি চাকরিতে সিনিয়রিটির দৌড়ে আমি এগিয়ে থাকতাম। তারচেয়েও বড় কথা আমার বাবা মা দেখে যেতে পারতেন আমি একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আমি স্রেফ স্ট্রাগলিং ডক্টর নই।
আমি পরিষ্কার জানি আমার এইটুকু পিছিয়ে পড়ার একটাই কারণ- আমি কোন স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলাম না৷
আমি যদি তখন, সেই সময়ের বাজারে দশটা হাজার টাকাও কোর্স থেকে ভাতা হিসেবে পেতাম আমাকে বাড়তি রোজগারের জন্য ওরকম কঠিন একটি চাকরি করতে হতোনা।
আমার সেই ক্ষতিটি হয়ে যাবার পরই লক্ষ করলাম রেসিডেন্সি কোর্সে বেসরকারি কোর্সের ছাত্রদের ভাতা দেওয়া শুরু হয়েছে। শুরুতে দশ হাজার ছিল সম্ভবত। পরে বিশ করা হলো। ডেপুটেশন সিস্টেম অর্গানাইজ করা হলো। আমাদের কাছে যেটা স্বপ্নের মত ছিল সেই কাজটি বাস্তবে পরিণত করলেন প্রফেসর প্রান গোপাল দত্ত। ধন্যবাদটা দেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও। যদিও আমি সেই সুবিধা আলাদা করে পাইনি, কারণ তদ্দিনে আমি আর বেসরকারি কেন্ডিডেট নই। কিন্তু আমাদের উত্তরসুরীরা পাচ্ছে এটা দেখেই আমার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গেছে।
অনেক গুলো বছর যাবার পর নন রেসিডেন্সি কোর্সের ছাত্ররাও ভাতা পেতে শুরু করল। এই কাজটি করলেন বিএসএমএমইউ এর বর্তমান ভিসি অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ স্যার৷ তিনি এর জন্য অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছেন। প্রান গোপাল স্যার এর মতই তিনি ডায়নামিক ছিলেন। কাজটা আদায় করেছেন খুব সুন্দর ভাবে৷ তিনি আরেকটি চমৎকার কাজ করেছেন। কোর্স আউট হয়ে যাওয়া ডাক্তারদের ডেকে এনে পুনরায় সুযোগ করে দিয়েছেন কোর্স কন্টিনিউ করার জন্য। শুধু এই কাজটির জন্য আমার মত পোস্ট গ্রাজুয়েশনে পোড় খাওয়া চিকিতসকের মনে তিনি আজীবন নায়কের আসনে থাকবেন।
কিন্তু গত নয়মাসে নানাকারণে নন রেসিডেন্সির ভাতাটি বন্ধ থাকায় স্যার আজ অসংখ্য ডাক্তারের চোখে ভিলেন হয়ে গেলেন যেখানে উনার হাত খুবই সামান্য। অনেকেই বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনা যে এই টাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা ভিসি প্রশাসন খেয়ে ফেলেছে। সরকারি চাকরি করার সুবাদে আমি জানি যে এটা প্রায় অসম্ভব। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্ট কোন পারসোনাল একাউন্ট না৷ এখানকার ট্রাঞ্জেকশন এক হাতে হয়না। গোপনেও করা সম্ভব না। আপনি পারচেজ করে টাকা মারতে পারবেন, নিয়োগ বাণিজ্যও করা সম্ভব কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে যে টাকা বরাদ্দ হয়েছে সেই টাকাকে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না।
আমি বিশ্বাস করিনা শারফুদ্দিন স্যারের কোন সদিচ্ছার অভাব আছে। সমস্যাটা মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসূত্রিতা, আর কিছুনা৷ অতীতেও একাধিকবার রেসিডেসি কোর্সের ভাতা এমনভাবে আটকে গিয়েছিল। সেই জট আবার খুলেছেও। বিসিপিএসও একই ঘটনা ঘটে৷ কারণ এই সিস্টেমটা অর্গানাইজড না৷
যাই হোক, ক্রমাগত চাপের কারণে, আন্দোলনের মুখে স্যার সঠিকভাবে হয়ত আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলতে পারেননি, তার স্বভাবসুলভ আন্তরিক ব্যাবহারটি করতে পারেননি। কিন্তু তিনি আন্তরিক নন এটা সত্য না।
পোস্ট গ্রাজুয়েট ছাত্রদের দাবী ভীষণ যৌক্তিক৷ কিন্তু আন্দোলনটা যেন হঠকারিতায় পরিণত না হয়৷ আন্দোলনকারীদের চেয়েও মজা দেখা পার্টিরা আরেক কাঠি সরেস। একজন ভিসিকে যে ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে তা খুবই দু:খজনক।
প্রফেসর শারফুদ্দিন আহমেদ কোন ভুইফোড় ব্যাক্তি নন। তিনি হঠাৎ ভিসি হননি। জাতীয় পর্যায়ের চিকিসক নেতা, সাবেক প্রোভিসি, ওএসবির সাবেক প্রেসিডেন্ট। দীর্ঘ সময়ের পরীক্ষীত কর্মযোদ্ধা তিনি।
উনার টার্মের ঠিক শেষ সময়ে এসে একের পর এক বৈরি পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ যেন এক রীতিতে পরিণত হয়েছে। অতীতে ভিসি প্রোভিসি হাতাহাতি অব্দি হয়েছে। তবে সুখের কথা ছিল যে সেসব তারা বাইরে আসতে দেননি। যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ। এখন দেশের সব ডাক্তাররা মিলে এই বরেন্য শিক্ষককে অপমান করে কথা বলছেন৷
এই অপমানে আসলে কার লাভ? এমনিতেই এই সমাজে ডাক্তারদের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। সবাই আমাদের প্রতি বৈরি। তখন নিজেরাই নিজেদের অপমান করার এক আত্মঘাতী খেলায় মেতেছি। অশালীন শব্দ প্রয়োগ, আক্রমণাত্মক আচরণ করে পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশটি নষ্ট করতে আমরা যেন উঠে পড়ে লেগেছি। আমার ছোটভাইবোনরা কি আর সাতটা দিন ধৈর্য ধরতে পারবেন না? এক ভিডিওতে ভিসি স্যারকে দেখলাম সাতদিন সময় চেয়েছেন।
আন্দোলনকারীদের মানসিক অবস্থা একরকম থাকে। সেটা আমরা বুঝি। কিনতু শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ তো বন্ধ হয়ে যায়নি। আপনারা যারা সিনিয়র তারা দয়া করে দায়িত্বশীল আচরণ করুন। এই আন্দোলন যদি ব্যক্তির বিরুদ্ধে হয় তাহলে কিন্তু মূল উদ্দেশ্য বিফল হয়ে যাবে৷ আন্দোলনটি হওয়া উচিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে৷
এই আমলা শাসিত রাষ্ট্রে একজন চিকিৎসক ভিসিকে যুপকাষ্ঠে ফেলে দিন শেষে পধহ চিকিৎসকরাই হেরে যাবেন। কোন একদিন কেউ একজন বলে বসবেন এখানে একজন অচিকিৎসক প্রশাসক দেওয়া হোক।
লেখক: রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ
আপনার মতামত লিখুন :