দেশ রুপান্তরের প্রতিবেদন।। হত্যার অভিযোগ, ক্ষমতা খাটিয়ে সম্পদশালী হওয়ার অভিযোগ, অর্থ পাচারের অভিযোগ এবং শেখ হাসিনার সরকারকে অন্ধভাবে সমর্থন জুগিয়ে সুবিধা পাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ভিভিআইপি-ভিআইপিরা ক্ষমতার পালাবদলের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ থেকে পালাতে চাইছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার এ ব্যক্তিদের আইনের আওতায় নিতে তাদের কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করেছে। বর্তমান সরকারের সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী, সাবেক এ ক্ষমতাবানদের সাধারণ পাসপোর্ট প্রাপ্তির আবেদন তখনই গ্রহণ করা হবে যখন তাদের বিষয়ে দুটি তদন্ত সংস্থা ইতিবাচক প্রতিবেদন দেবে; অথচ নেতিবাচক প্রতিবেদন দেওয়ার পরও আওয়ামী লীগের আমলের ১৮ ভিআইপি সাধারণ সবুজ পাসপোর্ট পেয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক বিচারপতি, সাবেক রাষ্ট্রদূত, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাবেক সিনিয়র সচিব, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ভিসি এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ও তাদের স্ত্রীরা।
গোয়েন্দা সংস্থা আপত্তি জানানোর পর বিষয়টির সুরাহা করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়য়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে পাঠায় পাসপোর্ট অধিদপ্তর। পুনঃতদন্তের বিধান থাকলেও সুরক্ষা সেবা বিভাগ তা না করে সরাসরি অনাপত্তি দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, এসব পাসপোর্টের আবেদনের বিষয়ে দুটি তদন্ত সংস্থা নেতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছিল মন্ত্রণালয়কে।
সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী লাল পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন জানালে তা দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এর পক্ষে তদবির করেন। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরে সংবাদ প্রকাশ হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। গত ৮ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ থাইল্যান্ডে যান। তার দেশত্যাগ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। গত ১৫ বছরে সরকারের সহযোগীদের বিচারের আওতায় নেওয়া এবং বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে অগ্রাধিকার হিসেবে নিয়েছে বর্তমান সরকার। সরকার যখন কঠোর অবস্থানে তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কূটনৈতিক পাসপোর্ট প্রত্যাহার করে সাধারণ পাসপোর্ট ইস্যুর বিষয়ে নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সাবেক মন্ত্রিসভার সদস্য, সদ্যবিলুপ্ত জাতীয় সংসদের সদস্যসহ যারা পদের কারণে কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়েছেন, নিয়োগ বা কর্মকাল শেষ হলে তাদের এবং তাদের স্ত্রীদের পাসপোর্ট অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। উল্লিখিতদের মধ্যে যারা সাধারণ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করবেন, অন্তত দুটি তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের অনুকূলে সাধারণ পাসপোর্ট ইস্যু করা যেতে পারে।
কূটনৈতিক পাসপোর্টধারী ভিআইপিরা হলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হাসিবুর রশীদ ও তার স্ত্রী রেহানা বেগম; সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও তার স্ত্রী সাকিন রহমান চৌধুরী; পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের কর্তা খুরশেদ আলমের স্ত্রী জাবীন আলম; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য এএসএম মাকসুদ কামালের স্ত্রী ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের ইংরেজি বিভাগের ডিন অধ্যাপক সৈয়দা আফসানা ফেরদৌসী; জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান সত্যজিৎ কর্মকার; পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সিনিয়র সচিব মোছাম্মৎ নাসিমা বেগম; বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান ও তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম; আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও তার স্ত্রী মারিয়াম খানম; কানাডার অটোয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক হাইকমিশনার খলিলুর রহমান ও তার স্ত্রী নাজনীন আক্তার; বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ ও তার স্ত্রী শান্তি ঘোষ; আবুধাবিতে দায়িত্ব পালন করা রাষ্ট্রদূত মো. আবু জাফরের স্ত্রী সালমা আহমেদ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া ও তার স্ত্রী খোদেজা বেগম; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য দ্বীন মোহাম্মদ নুরুল হক ও তার স্ত্রী রোজিনা হক; বুয়েটের সাবেক উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার; যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী বিলকিস ফেরদৌসী এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি কাশেফা হোসেন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. হাসিবুর রশিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা রয়েছে, যার তদন্ত চলছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব খুরশেদ আলম ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। সমুদ্রসীমা নির্ধারণবিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা পরিচালনাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন ও অন্যান্য সফলতার জন্য তাকে ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু পদক দেওয়া হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্যের বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় সাবেক দুই উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান ও অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল এবং প্রক্টর গোলাম রব্বানীসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোছাম্মৎ নাসিমা বেগমের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ১৫ লাখ পরিবারের কাছে বরাদ্দের টাকা না পৌঁছানোর অভিযোগ রয়েছে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা ও নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাবেক বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় সাবেক উপাচার্য ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার, বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে শাহবাগ থানায়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত আগস্টে পদত্যাগ করেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন।
বিচারপতিদের আন্দোলনে পদত্যাগে বাধ্য হন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানও পদত্যাগে বাধ্য হন।
বিগত সরকারের সময়ের এসব ভিআইপিকে সাধারণ পাসপোর্ট কেন দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্তি সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন) শামীম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্দেশনা মেনে পাসপোর্ট দিতে অনাপত্তি দেওয়া হয়েছে।’