মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ: বর্তমান সময়ের কোনো সেলিব্রেটি সম্পর্কে তার বিভিন্ন রেকর্ডেও বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে এক নিমেষেই বলে দিতে পারবেন অনেকেই। কিন্তু একজন মুসলিম হিসেবে আমরা কোন সাহাবিকে জীবন্ত শহীদ বলা হতো তা চেষ্টা করেও বলতে পারি না। কারণ এসব জিনিস নিয়ে আমরা যেভাবে গবেষণা করি, ইসলাম নিয়ে তার সিকিভাগও করি না। সূত্র: দেশ রূপান্তর
হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) একটি উট কেনেন মিসরে যাওয়ার জন্য। সেখানে পৌঁছা পর্যন্ত একটানা চালিয়ে যান। পরে হজরত উকবাহ ইবনে আমেরকে একটিমাত্র হাদিসের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। দীন ও ইসলামের বিষয়ে জানার ব্যাপারে কত আগ্রহী ছিলেন তারা, আর আমরা সময়ই পাই না!
জীবন্ত শহীদ উপাধি পেয়েছিলেন সাহাবি হজরত তালহা বিন উবায়দুল্লাহ আত তাইমি রাযিয়াল্লাহু আনহু। হিজরি তৃতীয় সনে মক্কার মুশরেকদের সঙ্গে সংঘটিত হয় উহুদ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হজরত তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) এক হাতে তলোয়ার আর অন্য হাতে বর্শা নিয়ে কাফেরদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। যুদ্ধের একপর্যায়ে মুসলিম বাহিনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তখন অল্প কজন সৈনিক আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘিরে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। হজরত তালহা (রা.) তাদের অন্যতম।
এ যুদ্ধে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আহত হন। তার দাঁত মোবারক শহীদ হয়। সে সময় হজরত তালহা (রা.) ছুটে এসে আহত রাসুল (সা.)-কে কাঁধে তুলে নিয়ে পাহাড়ের ওপর রেখে আবার শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হজরত আবু বকর (রা.) আর হজরত আবু উবাইদা (রা.) রাসুল (সা.)-এর সেবা করতে এলে তিনি তাদের বললেন, আমাকে ছেড়ে তোমাদের বন্ধু তালহাকে দেখো।
হজরত আবু বকর (রা.) বলেছেন, ‘আমরা তাকিয়ে দেখি, হজরত তালহা (রা.) রক্তাক্ত অবস্থায় একটি গর্তে অজ্ঞান হয়ে আছেন। তার একটি হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায়। সারা শরীরে তির আর বর্শার সত্তরটিরও বেশি আঘাত।’ হজরত আবু বকর (রা.) ওহুদ যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলেই বলতেন, ‘সে দিনের সবটুকুই তালহার!’
হজরত ওমর (রা.) হজরত তালহা (রা.) কে ‘সাহেবে উহুদ’ (উহুদওয়ালা) বলে ডাকতেন। এ যুদ্ধেই হজরত তালহা (রা.)-এর অসাধারণ ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন।
হজরত কায়েস ইবনে আবু হাজেম (রা.) বলেন, ‘আমি দেখেছি, সেদিন আঘাতের কারণে হজরত তালহা (রা.)-এর হাত অবশ ও নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। তিনি সে হাত দিয়েই নবী কারিম (সা.)-কে রক্ষা করেছিলেন। কী যে প্রাণপণ যুদ্ধ করেছিলেন হজরত তালহা (রা.)।’ -সহিহ বোখারি : ৩৭৬০
উহুদ যুদ্ধে হজরত তালহা (রা.)-এর বীরত্ব ও সাহসের নজিরবিহীন অবদানের জন্য হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, ‘যদি কেউ কোনো শাহাদাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াতে দেখে আনন্দ পেতে চায়, তাহলে সে যেন তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহকে দেখে।’
হজরত তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) বদর যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে পারেননি। কারণ, মদিনার ওপর আক্রমণ হতে পারে, এ আশঙ্কায় হজরত রাসুল (সা.)-এর আদেশে তাকে মদিনায় থাকতে হয়েছিল। তবে তাকে ‘বদরি সাহাবি’ হিসেবেই গণ্য করা হয়। কেননা, সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে তিনি অংশ নিয়েছিলেন।
খন্দকের যুদ্ধ, বাইয়াতে রিদওয়ান, খাইবার ও মুতার যুদ্ধসহ সব অভিযানেই তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের সূচনাপর্বে মাত্র ১৫ বছর বয়সে ইসলামের ছায়াতলে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। তার হাতের তালু ছিল সদাসিক্ত। সম্পদ সঞ্চয়ে তার অন্তরে দুঃখ হতো। তাই বিলিয়েছেন সম্পদ আর আনন্দ দিয়েছেন দীনদরিদ্র লোকদের।
হজরত জাবের (রা.) বলেছেন, না চাইতে এমন অঢেল দিতে তালহার চাইতে আর কাউকে দেখিনি। একবার ‘হাজরামাউত’ এলাকা থেকে সাত লাখ মুদ্রামানের সম্পদরাজি তার কাছে আসে। তিনি সে রাত পাখির অস্থিরতায় যাপন করেছেন। তার সহধর্মিণী সিদ্দিক তনয়া উম্মে কুলসুম (রা.) বললেন, এমন করছেন কেন, কী হয়েছে? তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, সারা রাত আমি এসব সম্পদ নিয়ে ভেবে হয়েছি ব্যাকুল। মনে মনে বলেছি, ওই ব্যক্তির ইমানের কী অবস্থা, যে ব্যক্তি এত বিপুলসম্পদ নিয়ে রাতযাপন করে? তার সহধর্মিণী বললেন, সকাল বেলায় এগুলো বিভিন্ন পাত্রে নিয়ে ভাগ করে দিলেই তো হয়। তখন হজরত তালহা (রা.)-এর চেহারা হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠে। তিনি খুশিতে বলে উঠলেন, আল্লাহ তোমাকে রহম করুন। সত্যিই তুমি সৌভাগ্যবানের সৌভাগ্যবতী মেয়ে।
সকালে হজরত তালহা (রা.) সেই সম্পদ মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। তার সহধর্মিণী উম্মে কুলসুম (রা.) বললেন, হে আবু মুহাম্মাদ (তালহা)! এই সম্পদরাজিতে আমাদের কি কোনো হিস্যা নেই? তিনি বললেন, দিনভর কোথায় ছিলে? এখন অবশিষ্ট যা আছে তাই নিয়ে নাও। তিনি একটি থলে নিয়ে দেখলেন, তাতে মাত্র এক হাজার দিরহাম রয়েছে। এভাবেই সমুদয় সম্পদ তিনি দান করেছিলেন খোদার রাস্তায়।
জঙ্গে জামাল বা উষ্ট্রীর যুদ্ধের সময় হজরত তালহা (রা.) হজরত আয়েশা (রা.)-এর পক্ষাবলম্বন করেন। সেই যুদ্ধে তিনি শাহাদতবরণ করেন। হিজরি ৩৬ সালে তিনি বসরা নগরীতে সমাহিত হন। বাষট্টি বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। বসরা শহরের ‘জাহিরা’ অঞ্চলে তার কবর রয়েছে।
এইচএ
আপনার মতামত লিখুন :