দক্ষিণ এশিয়ার এই অস্থিরতা ভারতের জন্য বড় মাথাব্যথা। কারণ বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার পথে থাকা দেশটি নিজ অঞ্চলের সমস্যাকে উপেক্ষা করতে পারে না।
চলতি মাসের শুরুতে নেপালে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার অল্প কয়েক সপ্তাহ আগেই ভারত নেপালের প্রধানমন্ত্রীকে নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, দুই প্রতিবেশীর টানাপোড়েন কমানো।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা অলি সেই সফরে যেতে পারেননি। আকস্মিক বিক্ষোভে দেশ অস্থিতিশীল হলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। দুর্নীতি, অভিজাততন্ত্র আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্ম ছিল এই আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি।
এর আগে গত বছর বাংলাদেশে তরুণ-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় ভেঙে পড়া অর্থনীতির বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভে রাজবংশের এক প্রেসিডেন্টকেও বিদায় নিতে হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার এই অস্থিরতা ভারতের জন্য বড় মাথাব্যথা। কারণ বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার পথে থাকা দেশটি নিজ অঞ্চলের সমস্যাকে উপেক্ষা করতে পারে না। 'ছোট' ও 'অপেক্ষাকৃত দরিদ্র' প্রতিবেশীরা বহুবার অভিযোগ করেছে—ভারত কখনও তাদের অগ্রাহ্য করে, আবার কখনও নিজেদের স্বার্থে চাপ প্রয়োগ করে।
নেপালের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো মাঝে মাঝে মানবিক সহায়তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল থাকে, আবার একইসাথে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের কারণে বিরক্ত হয়। আর প্রতিবেশী দেশে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হলে কিংবা নেতৃত্বে অনীহা দেখালে সেটি ভারতের জন্য আরও বড় ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি করে।
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের শূন্যতা চীনের প্রভাব বিস্তারের পথ সহজ করে দেয়। হিমালয় থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত অঞ্চলজুড়ে অবকাঠামো, জ্বালানি ও নির্মাণ প্রকল্পে অর্থ ঢেলে চীন ইতোমধ্যেই ভারতের 'প্রভাব বলয়ে' ঢুকে পড়েছে।
কানাডার এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ গবেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, 'ভারতের আত্মতুষ্ট হলে চলবে না। শুধু এই ভেবে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না যে প্রতিবেশীরা ভারতের সহায়তার প্রয়োজনেই শেষ পর্যন্ত ভারতের ওপর নির্ভর করবে। ঝুঁকি হলো—এই অস্থিরতা নতুন নেতাদের উত্থান ঘটাবে, যাদের অনেকেই ভারতের স্বার্থ বিরোধী হতে পারে।'
ভারত সবসময়ই এমন অংশীদারদের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলাকে গুরুত্ব দিয়েছে, যাদের সাথে তার ইতিহাস এবং সংস্কৃতি গভীরভাবে জড়িত। 'নেইবারহুড ফার্স্ট' বা 'প্রতিবেশী-প্রথম' নীতি তাই তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ।
দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ভুটান, পাকিস্তান এবং মালদ্বীপ সহ বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মানুষ বাস করে এবং এখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তরুণ জনসংখ্যা রয়েছে। ভারতের আঞ্চলিক কূটনীতি চীনের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব দ্বারা চালিত হচ্ছে। কারণ, দু'দেশই 'গ্লোবাল সাউথ'-এর নেতৃত্ব চাইছে।
ভারতের প্রাক্তন কূটনীতিক গৌতম বাম্ভাওলে বলেন, 'ভারতের বার্তা সহজ—ভারতের অর্থনীতি দ্রুত বাড়ছে, আপনারাও ভারতের সঙ্গে অংশীদার হলে একইভাবে বাড়তে পারবেন।'
কিন্তু প্রতিবেশীরা ভারতের পথ সবসময় মসৃণ করে দেয়নি। পশ্চিমে শত্রুভাবাপন্ন পাকিস্তান, পূর্বে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশ—যেখানে কখনও কখনও ভারতবিরোধী গোষ্ঠী সক্রিয় থেকেছে এবং যাদের সাথে ২৫০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে অবৈধ অভিবাসী নিয়ে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন আছে। দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা—যারা ভারতের উপকূল থেকে কয়েকশ মাইল দূরে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর নির্মাণের জন্য চীনকে অর্থায়নের আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং এটি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
এভাবে অনেক দেশ নিজেদেরকে ভারত ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় 'হাতিয়ার' মনে করেছে, আবার সুযোগ বুঝে কখনও এক পক্ষকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারও করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও 'ভারতবিরোধী' কিংবা 'চীনপন্থী' স্লোগান তুলেছে।
নেপালে অলি ছিলেন স্পষ্টভাবে চীনপন্থী। তবে তার উত্তরসূরি—অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি সবার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
৩ কোটি মানুষের দেশ নেপালের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গভীর, রয়েছে এক হাজার মাইলেরও বেশি উন্মুক্ত সীমান্ত। জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহেও ভারতীয় নির্ভরতা অপরিহার্য। তবুও গত এক দশকে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে।
২০১৫ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর যখন নেপাল পুনর্গঠনে ব্যস্ত, তখন ভারত রাজনৈতিক অস্থিরতার অজুহাতে তেলবাহী ট্রাক পাঠানো বন্ধ করে দেয়। নেপাল অভিযোগ করে, নতুন সংবিধান ভারতের ঘনিষ্ঠ নেপালি গোষ্ঠীর সুবিধার্থে সংশোধন না করায় দিল্লি শাস্তিস্বরূপ অবরোধ দিয়েছে। এতে প্রবল ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হয় এবং নেপাল চীনের সঙ্গে আরও চুক্তি সই করতে শুরু করে।
ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সহকারী অধ্যাপক অপেক্ষা শাহ বলেন, 'এটাই হয়ে উঠেছিল নেপাল-ভারত সম্পর্কে বড় বিতর্কের বিষয়। ভারত নেপাল-চীন সম্পর্ককে "জিরো-সাম গেম" দৃষ্টিতে দেখে।'
প্রতিবেশী রাজনীতিতে একতরফা খেলোয়াড় বেছে নেওয়ার জন্যও ভারত সমালোচিত। অনেক সময় জনপ্রিয়তা হারানো নেতৃত্বকেও তারা সমর্থন দিয়েছে। গত বছর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পরও তাকে ভারতের দৃঢ় সমর্থন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিক্ষোভকারীদের ওপর দমনপীড়নের অভিযোগে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হলেও ভারত তাকে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে দেখেছে। একই সময়ে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনাগুলো ভারতে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোকে ক্ষুব্ধ করেছে।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ভারত কার্যত বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। চলতি বছর দুই দেশ স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি বাণিজ্যও সীমিত করে। অন্যদিকে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। মার্চে তিনি বেইজিং সফরে গিয়ে একাধিক বাণিজ্য চুক্তি করেন।
পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসাইন হাক্কানি বলেন, 'নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ প্রতিবেশীদের মধ্যে বহু ধর্মীয় গোষ্ঠীকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। ভারতের জন্য হিন্দুত্ব হয়তো ঐক্যের প্রতীক, কিন্তু এটি বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের মুসলিমদের কিংবা শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধদের মন জয় করতে পারে না।'
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই বৈরী, দেশটি এখন চীনের আরও ঘনিষ্ঠ মিত্র। ফলে আঞ্চলিক সংহতি কার্যত অসম্ভব। তাই ভারত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও ছোট আঞ্চলিক জোট গড়েই অর্থনৈতিক-ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। ভারত মানবিক সহায়তায় সবসময় দ্রুত এগিয়ে আসে। গত এক বছরে আরও সক্রিয় ঋণদাতা ও অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নকারী হিসেবে ভূমিকা নিয়েছে তারা। আবার, রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ দিয়ে সম্পর্ক মজবুত করার চেষ্টা করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, মালদ্বীপ মাত্র ৫ লাখ মানুষের দ্বীপদেশ, কিন্তু ভারতের ও চীনের কাছে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৩ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের দাবিতে 'ইন্ডিয়া আউট' স্লোগান তুলে জয় পান। কিন্তু পরের বছরই তিনি ভারত সফর করেন, দুই দেশের সম্পর্ক গলতে শুরু করে। জুলাইয়ে মোদি ঘোষণা দেন, মালদ্বীপকে ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া হবে এবং মুক্ত বাণিজ্য আলোচনাও শুরু হবে।
তবুও বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাবই এখনও মূখ্য। কুগেলম্যান বলেন, 'অঞ্চলটি আসলে এক "বারুদভর্তি কৌটো", যেখানে সীমান্ত উত্তপ্ত, রাজনীতি বিভক্ত, জনগণ ক্ষুব্ধ এবং অর্থনীতি ভঙ্গুর।'
তিনি আরও বলেন, 'একটি পরাশক্তি হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষী দেশ হিসেবে, ভারতের একটি কৌশলগত উদ্দেশ্য থাকবে যাতে তার প্রতিবেশী দেশগুলো বাইরের লক্ষ্য থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া একটি ব্যয়বহুল সমস্যা না হয়ে দাঁড়ায়।'
সূত্র: দ্য বিসনেস স্টেনডার্ড বাংলা