এল আর বাদল : আমার ছয় বছরের মেয়েটাকে বহুদিন দেখিনি। ভেবেছিলাম সামনের মাসে বাড়ি যাব। কিন্তু ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে গেল। কবে যেতে পারব জানি না," ইসরায়েলের তেল আভিভ থেকে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন রাঘবেন্দ্র নাইক।
সেখানে তিনি কেয়ার গিভারের কাজ করেন। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের বাসিন্দা তিনি, কর্মসূত্রে ইসরায়েলে আছেন গত ১৩ বছর ধরে। ইসরাইয়েল ও ইরানের সংঘাতের মধ্যে উদ্বেগে রয়েছেন মি. নাইক। --- সূত্র, বিবিসি বাংলা
রাতে কান খাড়া করে থাকতে হয়, কখন সাইরেন বাজে। সাইরেনের আওয়াজ শুনলেই ভূগর্ভস্থ শেল্টারের দিকে দৌড়াই। গত কয়েক রাত আমি বা আমার আশপাশের কেউই ঘুমাতে পারিনি। যে হারে ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা হচ্ছে, তাতে এক এক সময় ভয় হয়, ফিরতে পারব তো?" কথাগুলো থেমে থেমে বলছিলেন রাঘবেন্দ্র নাইক।
ইসরায়েল তেলেঙ্গানা এসোসিয়েশনের সভাপতি সোমা রভির গল্পটাও প্রায় একই। তেল আভিভের কাছেই থাকেন তিনি।
রভি বলছিলেন, "গত সপ্তাহে আমার মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে এসেছে। ওর সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে গেল। কবে যেতে পারব জানি না।" প্রায় ২০ বছর আগে ইসরায়েল এসেছিলেন কাজের সূত্রে মি. রভি।
তাদের মতো আরও অনেক ভারতীয় এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষই ইসরায়েলে থাকেন। ইসরায়েল ও ইরানের সংঘাতে ইরান থেকে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
ভারতের পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে জারি করা নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, আটকে থাকা ভারতীয়দের ইসরায়েল থেকে স্থল সীমান্ত হয়ে প্রথমে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হবে। তারপর সেখান থেকে বিশেষ বিমানে তাদের দেশে ফেরানো হবে। তেল আভিভের ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা এই বিষয়ে নজর রাখবেন। যারা ফিরে আসতে চান, তাদের ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলা হয়েছে।
কাজ বা পড়াশোনার জন্য বহু ভারতীয়ই ইসরায়েলে রয়েছেন। ভারতের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটির প্রায় ২০০০০ হাজার কর্মী ইসরায়েলে আছেন। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।
ওই দেশে ভারতীয় কর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগই কেয়ার গিভারের কাজ করেন। তাছাড়া, নির্মাণ শ্রমিক হিসাবেও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ভারতীয়ই ইসরায়েলে পাড়ি দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে নার্স, কেয়ার গিভার এবং অদক্ষ শ্রমিকের জন্য ইসরায়েল কিন্তু ভারতীয়দের উপরই নির্ভরশীল।
ইসরায়েলের প্রবীণ নাগরিকদের একটা বড় অংশই এই কেয়ার গিভারদের উপর নির্ভর করেন।
অশীতিপর নিসিন মোসেরি মুম্বাই থেকে ইসরায়েল গিয়েছিলেন ১৯৬৩ সালে। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমার ছেলেরা যুক্তরাষ্ট্রে থাকে। আমার দেখাশোনা তো বটেই, সাইরেন বাজলে বোমা থেকে বাঁচতে ভূগর্ভস্থ আশ্রয়স্থলে যেতে হলেও আমাকে আমার কেয়ার গিভারেরই সাহায্য নিতে হবে।
ইসরায়েলে ভারতীয়দের সংখ্যা------
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক ১৮,০০০ থেকে ২০,০০০ ভারতীয় কর্মী ইসরায়েলে আছেন। তবে এই সংখ্যা আরও বেশি বলেই অনুমান করা হয়। কারণ, ২০২৩ সালে ভারতের সঙ্গে সে দেশের চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায়,বহু ভারতীয় কর্মী সেখানে গেছেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এরমধ্যে ২০২৫ সালের ১০ই মার্চ পর্যন্ত, ৬,৬৯৪ জন ভারতীয় কর্মী ইসরায়েলে পৌঁছেছেন। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়োগ করেছে।
পাশাপাশি ১৯৫টি ইসরায়েলি কোম্পানিতেও ভারতীয় কর্মী নিয়োগ হয়েছে। নির্মাণকর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগই নির্মাণ খাতে নিযুক্ত, কাঠামো নির্মাণ, লোহা বাঁকানো এবং প্লাস্টার করার মতো কাজ করেন।
এরপর গতবছর ইসরায়েল নির্মাণকর্মী এবং কেয়ার গিভার মিলিয়ে প্রায় ১৫,০০০ ভারতীয় কর্মী সে দেশে পাঠানোর অনুরোধ জানায় ভারতকে। তাদের মধ্যে কতজন ইসরায়েলে কাজে যোগ দিয়েছেন, সে বিষয়ে জানা যায়নি।
কি কাজ করেন -----
ইন্ডিয়ান ইকনোমিক ট্রেড অর্গানাইজেশন-এর প্রেসিডেন্ট ড. আসিফ ইকবাল বলেছেন, "ভারত থেকে মূলত কেয়ার গিভারের কাজ করেন তারা। মেল নার্স, নার্সিং অ্যাসোসিয়েট হিসাবে ভারতীয়দের চাহিদা রয়েছে।
"ইসরায়েলে প্রবীণ নাগরিকদের দেখাশোনা করার মানুষের অভাব। তাই ভারত থেকে, বিশেষত দক্ষিণ ভারত থেকে বহু ব্যক্তি কেয়ার গিভারের কাজ করেন। এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।"
"দ্বিতীয় যে সেক্টরে এখন কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। সেটা হলো, কন্সট্রাকশন। ইসরায়েলের বিভিন্ন অংশে ভবন তৈরি, মেরামতের কাজে বহু ভারতীয় কর্মী নিযুক্ত। ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশ পুনর্গঠনের জন্যও কর্মীদের নিয়োগ করা হচ্ছে। তবে এই কর্মীদের সংখ্যাটা নার্সের তুলনায় অনেকটাই কম" জানান আসিফ ইকবাল।
এছাড়াও তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক হলেও কর্মী রয়েছেন।
কেন ইসরায়েলমুখী ভারতীয়রা? -------
ইসরায়েলকে কর্মক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেওয়ার কী কারণ, জানতে চাইলে ম্যাঙ্গালরের বাসিন্দা পিএন লরেন্স বলেন, "এখানে মাইনে অন্যান্য অনেক দেশের চাইতে ভাল। আমি ইসরায়েলে ১৩ বছর কেয়ারগিভারের কাজ করার পর সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে এসেছিলাম, কিন্তু ইসরায়েলে ফিরে যাব ঠিক করেছি।"
পিএন লরেন্স আরও বলেন, "যুদ্ধের কথা মাথায় রেখেও বলব, ইসরায়েল কাজের জায়গা ভাল। এখানে সরকার বিদেশি কর্মীদের স্বাস্থ্যবিমা-সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেয়, যা অন্য দেশে নেই। এখানে আমরা যা আয় করি, তার উপর ভারতে থাকা আমাদের পরিবার নির্ভর করে। কোথায় যাব?
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইহুদী ------
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সে দেশে ৮৫০০০ ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইহুদী বাস করেন। ভারত থেকে ৫০ থেকে ৬০-এর দশকে ইহুদীদের অনেকে ইসরায়েলে যাওয়া শুরু করেন। মূলত মহারাষ্ট্র, তাছাড়া কেরালা, কলকাতা থেকেও ইহুদীরা সেখানে বসতি স্থাপন শুরু করেন। সাম্প্রতিক সময়ে মণিপুর ও মিজোরাম থেকেও সেখানে অভিবাসন দেখা গিয়েছে।
ষাটের দশকে মহারাষ্ট্র থেকে ইসরায়েলে গিয়েছিলেন আইস্যাক ওয়াস্কার। তিনি বলেন, "ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের অনেকেই ইসরায়েলে চলে এসেছেন আমাদের মতো। গত কয়েক বছরে এখানে ভারতীয় কর্মীরাও বিপুল পরিমাণে আসা শুরু করেছেন। তবে তাদের ভিসার মেয়াদ স্বল্প হয়। আগে কেয়ার গিভারের চাহিদা বেশি থাকলেও এখন নির্মাণকর্মীদের চাহিদা বেড়েছে। তার কারণ গাজা নিয়ে সংঘাতের কারণে ফিলিস্তিনিরা এখানে কাজ করতে পারেন না।
এখানে কাজের পরিবেশ ভাল। আর যারা ভারতীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইহুদী রয়েছেন, তারা একটা বড় পরিবারের মতো। সবাই সবার খোঁজ খবর রাখে।"
মি. ওয়াস্কার শেষবার ভারতে এসেছিলেন বছর তিনেক আগে। তার নাতনি স্তাভকে ছেলেবেলা থেকেই ভারতের বিষয়ে গল্প করতেন। স্তাভ বলেন, "আমি ভারতের গস্প দাদুর কাছে শুনে এসেছি।। আমার বাবা ভারতীয় বংশোদ্ভূত আর মা রোমানিয়ার।"
মি. ওয়াস্কার আপাতত জেরুজালেমে রয়েছেন। তিনি বলেন, "আগে গাজার সঙ্গে সংঘর্ষ চলছিল আর এখন ইরানের সঙ্গে। আমরা কোনোভাবেই নিরাপদ নই। আমাদের পরিচিত অনেকেই ইসরায়েল ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।