এল আর বাদল: ৫ আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকারের পতনের পর ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক আদালতের রায় ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘিরে তাঁর ভবিষ্যৎ অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছে। অন্যদিকে ভারত চাইছে তাঁকে আপাতত তৃতীয় কোনো দেশে পাঠাতে—যার মধ্যে মরিশাস বা ফিজি দ্বীপপুঞ্জের নাম আলোচনায় রয়েছে। তথ্যসূত্র, ঠিকানা/নিউইয়র্ক
গত ১৭ নভেম্বর মৃত্যুদন্ড দিয়েছে বাংলাদেশের ‘আইসিটি’ আদালত। নিজের গড়া বিচারালয়টি বুমেরাং হয়ে আঘাত হেনেছে। আশ্রয়দাতা দেশ ভারতও সমাদর কমিয়ে দিয়েছে। অনেকগুলো অঙ্ক বদল হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ-ভারত বন্দিবিনিময় চুক্তিটি ২০১৩-তে করেন নিজেই। সেটির দোহাই দিয়ে ফেরৎ নিতে চাইছে বাংলাদেশ সরকার।
অন্যদিকে আশ্রয়দাতা ভারত চাইছে দীপান্তরে পাঠাতে। আপাতত মরিশাস বা ফিজি দ্বীপপুঞ্জে। কিন্তু শেখ হাসিনার টার্গেট সুদূর আমেরিকা। মুখে আবেগ দিয়ে টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জের কথা বলছেন। কিন্তু মনের গহীনে বধূহীন সন্তান জয়ের সান্নিধ্য একান্তকাম্য। এজন্যে দশ দফার প্রাক-প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেছেন।
২০২৪-এর ৫ আগস্ট ছাত্র-গণ অভুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন ও পলায়ন। শেখ হাসিনা, পুত্র জয়, কন্যা পুতুলের বাংলাদেশি পাসপোর্ট বাতিল হয়। ফলে পুত্র জয়কে মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণের প্রস্তুতি নিতে হয়েছে।
নাগরিকত্ব নিতে বৈধ আয়, বৈধ সম্পদ থাকতে হয়। আয়কর বা ট্যাক্স পরিশোধও যথাযথ হতে হয়। সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় সবকিছু নগদায়ন করেন। ২০০২-এর ২৬ অক্টোবর বিয়ে করেন ক্রিস্টিনা ওভারমায়ারকে।
২০২২-২০২৩-এ জয় দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয়। কন্যা সোফিয়া রেহানা ওয়াজেদ চলে যায় মায়ের সাথে। ফলে হাসিনাপুত্র জয় সংসারে এখন সম্পূর্ণ একাকী।
দুটি বাড়ি বদলে একটি বড় বাড়ি কেনেন ভার্জিনিয়ায়। টার্গেট মা হাসিনাসহ নতুন বধূকে নিয়ে বসবাস। বাড়ির মালিকানায় আপাতত একটিই নাম। সঙ্গত কারণে তা ‘সজীব ওয়াজেদ জয়’।
জীবনের নতুন অধ্যায়ে নিজেকে মামলামুক্ত হতে হয়েছে। এফবিআই-এর কাছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিষয়ক অভিযোগ ছিলো। তবে আইনি প্রক্রিয়ায় তা স্থগিত রাখা হয়েছে।
পরিবারের বিরুদ্ধে দেশে দুদক-এর মামলা ঠেকাতে লবিস্ট নিয়োগ করা। এক্ষেত্রে দুই লাখ ডলার-এর বৈধ চুক্তিপত্রও রয়েছে। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর অবশেষে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ। ২০২৫-এর ২৫ মে অন্যান্য ২২ জনের সঙ্গে এই দুর্লভ প্রাপ্তি।
বৈধ নাগরিকেরা বাবা-মা, ভাই-বোনকে আমেরিকায় নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে ইমিগ্র্যান্ট বা অভিবাসন ভিসার আবেদন করতে হয়। আবেদনকারীর বয়স হতে হয় ২১ বছরের উর্ধ্বে। ১-১৩০ ফরমে ‘পিটিশন ফর অ্যালিয়েন রিলেটিভ’ দাখিল করার নিয়ম।
মা শেখ হাসিনার জন্যে এমন আবেদন প্রক্রিয়াধীন। বোন সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও সুযোগটি নিতে পারবেন। বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা (এলপিআর) বা মার্কিন নাগরিকত্ব থাকতে হয়। জয় এখন বৈধ ক্যাটাগরিতেই আবেদনের যোগ্য। তবে মার্কিন পাসপোর্ট হাতে পেয়ে তবেই আবেদনে আগ্রহী।
শেখ হাসিনা সন্তান জয়ের সংসারে যুক্ত হতে একান্ত আগ্রহী। প্রথমত আবার বিয়ে করাতে চান বধূহীন জয়কে। এজন্যে নিকটজনদের মেয়ে দেখতেও বলেছেন। তবে এবার আর বিদেশিনী নয়, শতভাগ বাঙালি কন্যা খুঁজছেন।
ভার্জিনিয়ার ‘ম্যানশনসম’ বিশাল বাড়িটি জনমানবশূন্য। সেখানে একদিকটায় তিনি ‘মিনি গণভবন’ বানাতে চান। রাজনৈতিক জীবনের আবহ বজায় রাখতে আগ্রহী।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভিকে সম্প্রতি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জয়। বাড়ির নিরাপত্তা বিষয়ে বলেছেন চমকপ্রদ কথা। বলেন, এখানে যতো চাই আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি রাখতে পারি। আমেরিকায় সেসবের কোন লিমিট নেই। আমার এই বাড়ি ঢাকার ৩২ নম্বর নয়। এখানে কেউ কিছুই করতে পারবে না।
মার্কিনমুখী হতে শেখ হাসিনার প্রস্তুতি ব্যাপক। আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগকে করেছেন পরিপুষ্ট। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন অপেক্ষারত। ডিবি হারুন, প্রেসক্লাবের বিদায়ী সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, এমপি, ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর বিদায়ী সম্পাদক নঈম নিজাম, নয়াদিল্লির বিদায়ী প্রেস মিনিস্টার শাবান মাহমুদও নিউইয়র্কে। শেখ হাসিনা পৌঁছুলেই গড়তে পারবেন রাজনৈতিক সাম্রাজ্য।
আমেরিকা বিষয়ে শেখ হাসিনার পূর্বোক্ত বয়ান ছিলো আক্রমণাত্মক। জুলাই আন্দোলনে অর্থায়ন, ডিপস্টেট, মেটিকুলাস ডিজাইন, সেন্টমার্টিনে ঘাঁটি। গত ১৪ নভেম্বর বিবিসি ১৮-কে দিয়েছেন নতুন বয়ান। ‘আমাদের সরকার পরিবর্তনে আমেরিকার কোন হাত ছিলো না।’ এমন বক্তব্যে পক্ষ-বিপক্ষ সবাই হতবাক হয়েছেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ, শেখ হাসিনা ক্রমশই মার্কিনপন্থী হয়ে উঠছেন। ইন্দোমার্কিন চ্যানেলে খুঁজছেন জীবনের নতুন গতিপথ, যদিও তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
এদিকে ‘মৃত্যদন্ড রায়ে’র পরপরই চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। বন্দিবিনিময় চুক্তি মানতে তাগাদা দিয়েছে ভারতকে। প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশ-ভারত বৈঠক হয়েছে। দু’দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের সভা।
অজিত দোভাল ও ড. খলিলুর রহমানের শলা-পরামর্শ। শেখ হাসিনাকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর আলোচনা হয়। ড. খলিল বলেন, ‘হাসিনা ইজ ডেডকেস’। প্রত্যুত্তরে মি. দোভালও বলেন ‘মোস্ট প্রোবাবলি’।
বন্দিবিনিময় চুক্তির অবমাননা বিষয়ে আইন উপদেষ্টা মুখ খোলেন। ড. আসিফ নজরুল বলেন ভারত অতীতে মেনেছে।
উলফা’ নেতা অনুপ চেটিয়াকে এই আইনে ফেরৎ নিয়েছে। আবার মুজিবহত্যার এক আসামীকে ফেরৎ দিয়েছে, যাকে হাসিনা সরকারের আমলে ফাঁসি দেয়া হয়। এখন ফাঁসির আসামী হাসিনা-কামালকে দিচ্ছে না কেনো। প্রয়োজনে রোমের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আমরা যাবো। বন্দিবিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নে রায় আনা হবে।
উল্লেখিত বক্তব্যে টনক নড়ে ভারতীয় নীতি-নির্ধারকদের। এজন্যে শেখ হাসিনাকে দ্রুত ভারতছাড়া করতে আগ্রহী। আপাতত মরিশাস বা ফিজি দ্বীপপুঞ্জে পাঠাতে চায়। কিন্তু রাজনীতিক হাসিনা দীপান্তরে যেতে আগ্রহী নন। একাকীত্বের অন্ধকারে জীবন অসহনীয় হবে বলে প্রকাশ। তিনি সন্তান জয়সহ আমেরিকায় বসবাসে আগ্রহী। ইমিগ্র্যান্ট ভিসার বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী। কার্যকর পদক্ষেপও শুরু হয়, কিন্তু ‘ব্যাডলাক’।
মৃত্যুদন্ডাদেশ-এর কারণে মার্কিন ভিসা আপাতত অনিশ্চিত। ফলে দুটি পদক্ষেপ এখন আলোচনায়। জাতিসংঘ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফাঁসির রায় পরিবর্তন। প্রয়োজনে যাবজ্জীবন কারাদন্ড স্থিত হোক।
ক্যাপিটেল পানিশমেন্ট’ বা ফাঁসির বিরুদ্ধে ঢের মানবাধিকার সংগঠন। শেখ হাসিনার প্রত্যাশা তাদের আন্দোলনে ফল আসবে। সে লক্ষ্যে বিশেষ কার্যক্রম চালাচ্ছে লবিস্ট ফার্ম। আর গোপনে চলছে আমেরিকার পিঠে পা রাখার জোর প্রচেষ্টা।