মহসিন কবির: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থীরা গণসংযোগ করছেন। তারা জানান দিচ্ছেন আমরা আছি ভোটের লড়াইয়ে। জামায়াতর গ্রিন সিগনাল পাওয়া প্রার্থী নেমে পড়েছেন। বিএনপি সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
দলের একক প্রার্থী নিশ্চিতে আসনভিত্তিক সম্ভাব্য প্রার্থীদের রাজধানীর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ডেকে কথা বলছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এ ছাড়া বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নে উদযাপনে বিএনপি নেতাকর্মীরা সনাতন সম্প্রদায়ের পাশে থেকে কাজ করছেন। পূজা শেষে নির্বাচনমুখী জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি ঘোষণা করে সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে যাবে দলটি।
অন্যদিকে, এরই মধ্যে মোট তিনশ সংসদীয় আসনের প্রায় সবকটিতেই অনানুষ্ঠানিকভাবে দলীয় একক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। সেইসঙ্গে আসনভিত্তিক ওইসব প্রার্থীর পক্ষে ‘নির্বাচনী’ ব্যানার-পোস্টার ও ফেস্টুন সাঁটানো হয়েছে। পাশাপাশি অবিলম্বে আইনি ভিত্তি দিয়ে জুলাই সনদ ঘোষণা ও বাস্তবায়ন এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ পাঁচ দাবিতে তিন দিনের কর্মসূচি পালন করেছে জামায়াতে ইসলামী। অবশ্য বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের ‘নির্বাচনী’ ব্যানার-পোস্টার এখনো তেমনটা দৃশ্যমান হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি এবং দলটির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামী বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল ও অবস্থান নিয়ে এগোচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে দুই দলের মধ্যে এক ধরনের দ্বিমুখী প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা দেশের রাজনীতিতে নয়া মেরূকরণের ইঙ্গিত বলে মনে হয়। একসময় যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের আন্দোলন করেছে, এখন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে স্পষ্ট কৌশলগত দূরত্ব।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে শুরু থেকেই যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ কাজকে প্রাধান্য দিয়ে গত ২৮ আগস্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ ঘোষিত এই রোডম্যাপে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে—সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা চূড়ান্ত, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন এবং দেশের পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন চূড়ান্ত করা। ইসি আগেই জানিয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে। আর তপশিল ঘোষণা করা হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোও নড়েচড়ে বসেছে।
জনগণের কাছে যাবে বিএনপি: বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে, জনগণের ম্যান্ডেট নিশ্চিত করতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন অপরিহার্য। তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য চাপও দিয়েছে। তবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিভন্ন সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী এবং জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা তরুণদের নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতানৈক্য তৈরি হয়।
সর্বশেষ জুলাই সনদের ঘোষণা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মতানৈক্য এখনো রয়েই গেছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বিএনপির বিরুদ্ধে নানা রকম নেতিবাচক প্রচারণা চলছে বলে অভিযোগ দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের। তারা বলেন, দেশের মানুষ যখন নির্বাচনমুখী, তখন বিভিন্ন ইস্যুতে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল মাঠ গরমের হুংকার দিচ্ছে, যা তাদের দ্বিচারিতা ও স্ববিরোধিতা।
জানা গেছে, নির্বাচন সামনে রেখে ‘ডোর টু ডোর’ ক্যাম্পেইন কর্মসূচিতে নামবে বিএনপি। দলটির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে যে নানামুখী প্রোপাগান্ডা চলছে, সেটি আমলে নিয়ে এবং জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের কর্মসূচি হাতে নেবে দলটি। এর মধ্য দিয়ে দলটি মূলত নির্বাচনের মাঠে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে চায়। সম্প্রতি বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
চলছে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই: গত সপ্তাহ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছে বিএনপি। এরই মধ্যে বরিশাল, কুমিল্লা এবং রাজশাহী অঞ্চলের বেশকিছু আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত শীর্ষ নেতা ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা কথা বলেছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ এবং ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনকে বরিশাল ও কুমিল্লা বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিরোধপূর্ণ আসনগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকরা তাদের সহযোগিতা করছেন। অক্টোবর মাসের মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা চূড়ান্ত করতে চায় দলটি। দলীয় প্রার্থী ঠিক করার পাশাপাশি সমমনা ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের জন্য আসন ছাড় ও মনোনয়নের বিষয়টিও দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চান বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তারা মনে করছেন, এ ক্ষেত্রে বেশি সময় নেওয়া হলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সুযোগ নিতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল শুক্রবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচনমুখী কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাব, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আছে। তবে কর্মসূচির ধরন এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কর্মসূচি ঠিক করা হলে জানানো হবে।’
প্রার্থী বাছাই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা হচ্ছে নির্বাচনপূর্ব প্রাক-বাছাই প্রক্রিয়া। কেননা, অনেক এলাকায় আমাদের প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। সেখানে সবাইকে ডেকে কথা বলা হচ্ছে যে, দলের পক্ষে যাকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হবে, সবাইকে তা মেনে তার পক্ষে কাজ করতে হবে। সেজন্য নেতাকর্মীদের প্রস্তুত করতে হবে। নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত করার আগে এ ধরনের অনেক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থাকে, এখন সেগুলোই করা হচ্ছে। সারা দেশেই দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা চলছে।’ সেইসঙ্গে শরিকদের জন্য কিছু আসন বিএনপি ছাড়বে বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমদ।
দুই প্রস্তুতিতে জামায়াত: বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিসহ পাঁচ দফা দাবিতে গতকাল পূর্বনির্ধারিত তিন দিনের কর্মসূচি পালন শেষ করে দলটি। আজ শনিবার দলীয় ফোরামে বসে আবারও নতুন কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেবে জামায়াত। দলটির সঙ্গে আরও ছয়টি দল অভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। এসব দলের অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে—জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন, নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণ, ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারী শক্তির দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রায় তিনশ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম অনানুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার পাশাপাশি আসনভিত্তিক প্রার্থীদের বিভিন্ন পোস্টার, ব্যানার সাঁটানো হয়েছে জামায়াতের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ড, কর্মিসভা, উঠান বৈঠক, পথসভা, লিফলেট বিতরণ, অগ্রসরমানের কর্মিসভাসহ বহুমুখী কর্মকাণ্ড নিয়ে কাজ করছেন জামায়াতের সংশ্লিষ্ট প্রার্থীরা। শুধু তাই নয়, কূটনৈতিক অঙ্গনে সম্পর্কোন্নয়নেও তৎপরতা বাড়িয়েছে দলটি। জামায়াতসহ তাদের ঘনিষ্ঠ কিছু রাজনৈতিক দল মনে করে, শুধু নির্বাচনই যথেষ্ট নয়। গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনাকে ধরে রাখতে হলে আগে প্রশাসনিক, সাংবিধানিক ও আইনি সংস্কার করতে হবে এবং শেখ হাসিনার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তাদের মতে, এসব সংস্কার ছাড়া অতীতের মতোই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবর রহমান বলেন, ‘৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ছিল জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। সেটি পূরণের জন্য আগে কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। আমরা মনে করি, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে তা জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে না। দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা আর স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে দূরে ঠেলে দেওয়া—এই দ্বৈত চরিত্র জনগণ বুঝতে পারছে। আমরা সুদূরপ্রসারী কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। জনগণের বিপ্লবের ম্যান্ডেট হলো সংস্কার এবং ন্যায়বিচার, এরপর নির্বাচন।’
নির্বাচনী প্রস্তুতি প্রসঙ্গে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদমস্য (এমপি) এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচন ও আন্দোলন দুই প্রস্তুতিতেই আছি। নির্বাচনের প্রস্তুতি চলমান। ৩০০ আসনেই প্রার্থী স্থানীয়ভাবে ঘোষিত হয়েছে।’
পাঁচ দাবিতে আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগামীকাল (আজ শনিবার) আমরা বৈঠকে বসব, সেখানে পরবর্তী কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তবে আমরা বিশ্বাস করি, সরকার জনগণের দাবি মেনে নেবে। কারণ, জামায়াতের দাবি জনগণের পক্ষের দাবি।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, জামায়াতের ‘সংস্কার প্রথম, তারপর নির্বাচন’ নীতি মূলত দুটি উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা। প্রথমত, সংস্কার প্রক্রিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা; দ্বিতীয়ত, বিএনপির ওপর কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করে নির্বাচনী জোটে আরও অনুকূল শর্ত আদায়। অন্যদিকে, বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে ক্ষমতায় ফিরতে চাইছে।
তবে উভয় দলের নেতৃত্বই প্রকাশ্যে জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের কৌশলগত দূরত্ব বাড়ছেই। এমন পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের নির্বাচন হবে না, এটি একই সঙ্গে দুই সাবেক মিত্রের মধ্যকার রাজনৈতিক প্রাধান্য ও কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইও হবে। এই দ্বিমুখী প্রস্তুতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেয় এবং তা দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।