জাহিদ হোসেন: গানের ক্ষেত্রেও আমি বহুগামী। এই বহুগামিতার ধরন নিয়ে বলার আগে একটা গৌরচন্দ্রিকা আছে। মানুষ কেন গান গায়? না, পয়সা বা খ্যাতির জন্য নয়। কারণ লক্ষ বছর আগে যখন গান বা সুরের প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল তখন মানুষের ‘আমার’ ধারণা তৈরি হয়নি। অর্থাৎ মানুষ তখন, ‘এই জমি আমার, এই জামা আমার’ এমন ধারণায় অভ্যস্ত হয়নি। ‘আমার’ বলে তখন কিছু ছিলো না। সবই ছিলো ‘আমাদের’। ফলে উপার্জনের উদ্দেশে সুর তৈরি করেনি মানুষ। খ্যাতির লোভও তখন ছিলো না। তাহলে গান কেন গেয়েছে সেই আদিম কালের মানুষ? গেয়েছে। কারণ মানুষ গান সঙ্গে নিয়েই জন্মায়। গান মানুষের সহজাত। হরিচরণ ব্যানার্জির মতে, সহজাত শব্দের অর্থ হচ্ছে, ‘সহিত জাত’- একই সঙ্গে উৎপন্ন, উদ্ভূত বা প্রসূত। গানের মতো নাচ, আঁকা, খেলা, ভাবা, লেখা এসবও সহজাত নিজস্বতা। সেই আদিকাল থেকে প্রতিটি মানুষ নিজস্ব রুচি, দক্ষতা আর আগ্রহ নিয়ে জন্মেছে। এগুলোর সম্মিলিত রূপই একত্রে মানুষের সহজাত প্রবণতা বা বেসিক ইন্সটিঙ্কট।
একটা উদাহরণ দিই। এই যে মায়েরা বাচ্চাদের গান গেয়ে ঘুম পাড়ায়। যাকে ইংরেজিতে বলে ললাবাই। এটাই পৃথিবীর আদি সুর। আদি গান। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, সারা পৃথিবীর সব রকম ঘুমপাড়ানি গানের সুরে একটা মিল আছে। হার্ভার্ডের মিউজিক ল্যাবের ডিরেক্টর স্যামুয়েল মেহরের মতে, সকল ললাবাইয়ের সুরে একটা ‘প্রশান্তিদায়ক’ ব্যাপার আছে যা দেশ কাল ভেদে সকল শিশুকে শান্ত করে। হাসি, কান্না, হাত নাড়া, মাথা নাড়ার মতো, সুরও মানবজাতির অন্যতম বৈশ্বিক ভাষা। মানুষ ছুরি চাকা বানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বাঁশিও বানিয়েছে। ললাবাইয়ের সুরে আদিমাতারা যেমন ঘুম পাড়াতো শিশুদের, শিঙা ফুঁকে জড়ো হয়ে তালে তালে পা ফেলে যেমন শিকারে যেতো আদি-পিতারা, আজও তেমন মায়েরা গানে গানে ঘুম পাড়ায়, সৈনিকেরা মার্চপাস্ট করে, বিউগল বাজায়। সুতরাং যেহেতু সুর দিয়েই শুরু। যেহেতু গানেই জ্ঞান। যেহেতু মানবজাতির ইতিহাস আর সুরের ইতিহাস এক। গান আর প্রাণও তাই আমার কাছে নিরন্তর সুখ-সহবাসে নিমগ্ন থাকার উপায়। আর গানের মধ্যে লোকসঙ্গীত আমাকে বেশি উসকানি দেয়। বিস্মিত করে। ফেসবুকে ১২-১২-২৩ প্রকাশিত হয়েছে।
