শিরোনাম
◈ নিউইয়র্কে পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুলকে মরণোত্তর পদোন্নতি, জানাজায় মানুষের ঢল ◈ ভুটানের লি‌গে খেলছেন ঋতুপর্না চাকমা, এবার অস্ট্রেলিয়ান লিগে খেলার প্রস্তাব পেলেন ◈ জুমার দিন: রহমত, বরকত ও অশেষ সওয়াবের সুবর্ণ সুযোগ ◈ আজীবনের জন্য বাহরাইনে স্থায়ী ব্যবসার ও বসবাসের সুযোগ, মাত্র ৫ দিনার ফিতে! ◈ জুলাই সনদ ঘোষণার দাবিতে আজও শাহবাগ মোড়ে জুলাই যোদ্ধারা ◈ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিকে ঐতিহাসিক কূটনৈতিক বিজয়: প্রধান উপদেষ্টা  ◈ সংলাপে পিআর নি‌য়ে উত্তেজনা, হুদা ‘স‌রি’ বলার পর শান্ত এন‌সি‌পি নেতারা (ভিডিও) ◈ বাংলাদেশে নেচে যাওয়া সেই নোয়েল ভারতে গিয়ে আটক হলেন ◈ বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার সম্ভাবনায় ১১ অঞ্চলে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত ◈ শার্শায় বিএনপি কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারি চাল ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ

প্রকাশিত : ০৩ জুন, ২০২৫, ১০:০১ দুপুর
আপডেট : ২৭ জুলাই, ২০২৫, ০৪:০০ সকাল

প্রতিবেদক : এল আর বাদল

করের চাপ, কালো টাকা সাদা- অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটের যত চ্যালেঞ্জ

এল আর বাদল : ক্ষমতা গ্রহণের দশ মাসের মাথায় প্রথমবার বাংলাদেশের বাজেট ঘোষণা করলো অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।

আগের বছরের চেয়ে সাত হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জন্য সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।

এবার এমন একটি সময় এই বাজেট দেওয়া হয়েছে, যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব ঘাটতি, বিদেশি ঋণের কঠোর শর্ত, বিনিয়োগে স্থবিরতাসহ বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনীতি বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। -- সূত্র, বি‌বি‌সি বাংলা

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে প্রথম ঘোষিত বাজেটে এসব সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে নতুন কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেটি ঘিরে এক ধরনের বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো।

কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগের রাজনৈতিক সরকারগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটে খুব একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। 

এবারের বাজেটে বেশকিছু ভালো উদ্যোগ বা প্রত্যাশার কথা বলা হলেও যে কাঠামোতে বাজেট দেওয়া হয়েছে, সেটি পুরনো। ফলে গতানুগতিক বাজেটের পুঞ্জীভূত সমস্যাগুলো এখানেও রয়ে গেছে। অথচ এই সরকারের সামনে ভিন্নধর্মী একটা বাজেট উপস্থাপনের সুযোগ ছিল, যা তারা সেভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হননি," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অর্থনীতি বিষয়ক বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান 'সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং' বা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।

বাজেটে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর পদক্ষেপ না নিয়ে আগের মতোই করদাতাদের করের হার বাড়ানো যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটিরও সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদরা। যদিও নতুন বাজেটকে "ব্যতিক্রমধর্মী" বলে অভিহিত করছেন অর্থ উপদেষ্টা।

আমাদের এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে," বাজেট বক্তৃতায় বলেন মি. আহমেদ।

উচ্চাকাঙ্ক্ষী' বাজেট--

অন্যান্য বছর জাতীয় সংসদে পেশ করা হলেও এবার সেটি না থাকায় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে বেতার-টেলিভিশনের মাধ্যমে।

প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ।

"মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে। ইতোমধ্যে চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাময়িক হিসাবে তিন দশমিক ৯৭ শতাংশ হয়েছে, যা চূড়ান্ত হিসাবে কিছুটা বাড়তে পারে। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি বৃদ্ধি পাবে এবং মধ্যমেয়াদে ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আমরা আশা করছি," বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন অর্থ উপদেষ্টা।

এছাড়া চলতি বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার সামনের বছর কমিয়ে সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। 

কিন্তু এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নতুন বিনিয়োগসহ অর্থনীতিতে যে ধরনের পরিবর্তন দরকার, সেটি আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

"ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগে বাড়ানোর জন্য যে বাঁধাগুলো রয়েছে, সেগুলো কতটুকু দূর করা গেছে? বরং দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে দেশে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের সবচেয়ে স্থবির অবস্থা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সেটি বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী বলেই মনে হচ্ছে," বলেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান।

বাড়েনি করমুক্ত আয়ের সীমা ---

এবার বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি। গত বছরের মতোই ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা রাখা হয়েছে। তবে ২০২৬-২৭ অর্থবছর এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।

এছাড়া নারী করদাতা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তৃতীয় লিঙ্গের করদাতা ও স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে এই আয়সীমা হবে পৌনে পাঁচ লাখ টাকা। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা পাঁচ লাখ টাকা হবে।

এছাড়া গেজেটভুক্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ এ আহত 'জুলাই যোদ্ধা' করদাতাদের জন্য ২০২৬- করমুক্ত আয়ের সীমা পাঁচ লাখ ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন করদাতাদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম করের পরিমাণ এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে পরের দুই বছর করমুক্ত আয়ের সীমা অতিক্রম করলে ন্যূনতম কর দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা।

বেসরকারি চাকরিজীবীদের করযোগ্য আয় হিসাব করার সময় সর্বোচ্চ বাদযোগ্য অঙ্কের পরিমাণ সাড়ে চার লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা হয়েছে।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের আয় ও সর্বজনীন পেনশন স্কিম হতে কোনো আয় ও জিরো কুপন ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট সার্টিফিকেট থেকে আয় করমুক্ত রাখা হয়েছে।

চাকরিজীবী কর্মচারীদের কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, হার্ট, মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার ও কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত চিকিৎসা ব্যয় বাবদ প্রাপ্ত অর্থ করমুক্ত রাখা হয়েছে।

কালো টাকা সাদা করার বিধান বহাল----

প্রস্তাবিত বাজেটে আগের বছরের মতো এবারও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবি বলেছে, সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে, যা অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থী।

সরকারের এমন সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রসংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যকে রীতিমতো উপেক্ষা করা হচ্ছে। সরকার দুর্নীতিকে উৎসাহ দিয়ে রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে," সোমবার প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
এমন সিদ্ধান্ত দুর্নীতিকে উৎসাহ দেবে, এমন আশঙ্কার কথা জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। 

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ একই সঙ্গে বৈষম্যমূলক। কারণ, এই সিদ্ধান্তের ফলে আবাসন খাতে অবৈধ অর্থের মালিকদের অধিকতর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সৎ উপার্জনকারীদের ফ্ল্যাট বা ভবনের অংশীদার হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে," বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

বাজেটের চ্যালেঞ্জ---

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিপরীতে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ও সামাজিক বৈষম্য দূর করা এবারের বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দু'টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বৈষম্যবিরোধী চেতনা ও কর্মসংস্থান। কিন্তু বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা না গেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না," বলেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান।

কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ বিভিন্ন কারণে নতুন বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে, করের আওতা না বাড়িয়ে সরকার যেভাবে করের হার বাড়িয়েছে, তাতে করদাতাদের ওপর চাপ বেড়েছে। কিন্তু এই করহারের বিপরীতে তাদের তাদের সামনে এমন কোনো সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরা হয়নি, যা দেখে তারা কর দিতে উৎসাহিত হবে," বলেন মি. রায়হান।

অন্যদিকে, রাজস্বখাতের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে যে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে, সেটি দ্রুত সমাধান করা না গেলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জিত হবে, সেটি নিয়েও শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
অন্যদিকে, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস হতে এবং এক লাখ এক হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে মেটানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ। এটাকেও নতুন বাজেটের একটি বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়