নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারিতে (দলীয় বাছাই) বড় জয় পেয়েছেন দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত তরুণ রাজনীতিক জোহরান মামদানি। সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে পরাজিত করে এই ঐতিহাসিক জয় এনে দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এই বিজয় নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
তবে জোহরানের এই উত্থানের নেপথ্যে ছিলেন এক তরুণ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী—জারা রহিম। ডিজিটাল কৌশল, গল্প বলার দক্ষতা ও জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ তৈরির মাধ্যমে জারা পুরো প্রচারণার গতিপথ বদলে দিয়েছেন।
বাংলাদেশি পরিবারের মেয়ে, মার্কিন রাজনীতির কৌশলবিদ
সাউথ ফ্লোরিডায় জন্ম নেওয়া জারা রহিম বাংলাদেশি অভিবাসী মা–বাবার সন্তান। সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইউসিএফ) যোগাযোগবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। পড়াশোনার সময়েই জারা উপলব্ধি করেন—প্রযুক্তি ও গল্প বলার সমন্বয় মানুষের মন জয় করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
জারার রাজনীতিতে প্রবেশ ২০১২ সালে—বারাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনী প্রচার দল থেকে। পরে তিনি কাজ করেন হোয়াইট হাউসের ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজি অফিসে, উবারে নীতি-সহায়তা বিভাগে, আর ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের প্রচারণায়। এরপর তিনি ভোগ সাময়িকীর যোগাযোগ পরিচালক হিসেবে কাজ করেন (২০১৭–১৮)।
পরবর্তীতে জারা যোগাযোগ পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন এ২৪, মারায়া কেরি ও নেটফ্লিক্সের মতো প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
মামদানির প্রচারণায় ‘প্রকৃত নিউইয়র্ক’
গত ফেব্রুয়ারি থেকে জোহরানের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন জারা রহিম। তার পরামর্শেই গড়ে ওঠে নির্বাচনী প্রচারণার মূল দর্শন—
“রাজনৈতিক কৌশলবিদদের বানানো কল্পিত নিউইয়র্ক নয়, প্রচার চালাও প্রকৃত নিউইয়র্ককে নিয়ে।”
এই ভাবনাই গড়ে দেয় তৃণমূলভিত্তিক এক আন্দোলন, যেখানে যুক্ত হন ৯০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক। তারা যোগাযোগ স্থাপন করেন সেইসব ভোটারের সঙ্গে, যাঁদের এতদিন শহরের রাজনীতি প্রায় উপেক্ষা করেছে।
প্রচারণায় জোহরান মামদানি সরাসরি মানুষের সঙ্গে কথা বলেন—স্প্যানিশ, হিন্দি ও বাংলা ভাষায়ও। নিউইয়র্কের মসজিদ, বাজার ও পাড়ায় গিয়ে তিনি মানুষের গল্প শোনেন। এতে প্রথমবারের মতো বিপুলসংখ্যক মুসলিম, দক্ষিণ এশীয় ও অভিবাসী ভোটার ভোটে অংশ নেন।
আধুনিক ডিজিটাল প্রচার ও তৃণমূল আন্দোলনের মেলবন্ধন
জারার পরিকল্পনায় প্রচারে ব্যবহৃত হয় টিকটক, ইনস্টাগ্রাম ও স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিও কনটেন্ট। তবে তিনি জোর দেন কেবল অনলাইন নয়—মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়ায়।
দলীয় প্রাইমারিতে স্বেচ্ছাসেবকেরা ১৬ লাখ পরিবারের দরজায় গিয়েছেন, কথা বলেছেন প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ভোটারের সঙ্গে। নির্বাচনের সময় সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ হাজার কর্মীতে।
প্রচারণা শুধু ভোটের আহ্বান ছিল না—জারা বলেন, “আমরা ভোট চাইনি, আমরা সম্পর্ক গড়েছি।”
জারার কৌশলে ঘুরে যায় আক্রমণের দিকও
প্রচারের সময় কুমো যখন জোহরানের সমর্থকদের নিয়ে ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য করেন, তখন জারা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেন। সিএনএনকে তিনি বলেন, “তিনি মুসলিমদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন শুধু এই বলে, ‘দেখো, এই খারাপ মুসলিমকে।’ এটা মরিয়া এক কৌশল, যার পেছনে কোনো বাস্তব বার্তা নেই।”
সিটি হলে বাংলাদেশের গর্ব
জোহরান মামদানি জানুয়ারিতে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন একটি নারী নেতৃত্বাধীন ট্রানজিশন টিমের। সেই দলে রয়েছেন জারা রহিম, লিনা খান, মারিয়া তোরেস-স্প্রিংগার, গ্রেস বনিলা ও মেলানি হার্টজগ।
সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ থেকে নিউইয়র্ক সিটি হল পর্যন্ত জারা রহিমের পথচলা প্রমাণ করে—যোগাযোগ শুধু বার্তা ছড়ানোর বিষয় নয়, বরং মানুষের মন বোঝার শিল্প।