শিরোনাম
◈ বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ২২% বৃদ্ধি, চীনের হারানো অর্ডার এলো দেশে ◈ বিরল দৃশ্যের অবতারণা, কাবা ঘরের ওপর নেমে এলো চাঁদ ◈ ফজলুর রহমানকে গালি দিয়ে স্লোগান দেওয়া সেই ফারজানা ১০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেপ্তার (ভিডিও) ◈ মাহফুজ আলমের ওপর হামলা চেষ্টা, লন্ডন পুলিশকে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান অন্তর্বর্তী সরকারের ◈ সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন আর নেই ◈ বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য চীনের ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া নিয়ে যে নতুন নির্দেশনা ◈ জনগণ রায় দিলে ৫ বছরেই দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন করা সম্ভব: জামায়াত আমীর ◈ সহকারী শিক্ষকদের জন্য নতুন নির্দেশনা, সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দিতে হবে যেসব তথ্য ◈ রাতে ঢাকাবাসীর জন্য দুঃসংবাদ দিল আবহাওয়া অধিদপ্তর ◈ ডাকসুর পর জাকসুতেও শিবিরের জয়জয়কার

প্রকাশিত : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১০:৫৮ দুপুর
আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৮:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

‘মাদার মেরি কামস টু মি’তে অরুন্ধতী রায়ের জীবন, সংগ্রাম ও পালানোর গল্প

লেখক অরুন্ধতী রায়। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের প্রখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায় তার নতুন স্মৃতিকথা মাদার মেরি কামস টু মি-তে নিজের জীবন ও পলায়নের গল্প বলেছেন। বিবিসির সূত্র অনুযায়ী, এই স্মৃতিকথার নানা বর্ণনা থেকেই উঠে এসেছে তার সাহিত্যিক খ্যাতি উপেক্ষা করে সেখান থেকে সরে আসার পেছনের কারণ, ব্যক্তিগত সংগ্রাম ও রাজনৈতিক অবস্থান। সাহিত্য ছেড়ে আদতে প্রান্তিক মানুষের কথা বলতে শুরু করেন তিনি। 

১৯৯৭ সালের বসন্তে অরুন্ধতী রায়ের প্রথম উপন্যাস দ্য গড অব স্মল থিংস আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে। এটি ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের নতুন ঢেউয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে ওঠে। সেই জুনে দ্য নিউ ইয়র্কার ভারতের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে একটি দলগত প্রতিকৃতি প্রকাশ করে। সালমান রুশদি ছিলেন ছবির কেন্দ্রে। তার পাশে ছিলেন বিক্রম সেঠ, অমিতাভ ঘোষ, অনিতা দেশাই ও রোহিন্টন মিস্ত্রি। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন কিরণ দেশাই, বিক্রম চন্দ্র ও অমিত চৌধুরী। মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন উজ্জ্বল মুখের অরুন্ধতী।

তিনি গোত্র, শ্রেণি, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও ক্ষমতার রাজনীতি নিয়ে তীক্ষ্ণ প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলেন। তিনি কথাসাহিত্য ছেড়ে দিলেন। তিনি মনোযোগ দিলেন প্রান্তিক ও নিপীড়িত মানুষের দিকে। নিজের ভাষায়—‘ইন্ডিয়ার শাইনিংয়ের উদ্বাস্তুদের’ দিকে। এটি ছিল এক ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কেবল ঘরানা বদল নয়, আনুগত্যেরও পরিবর্তন। ভারত তাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছিল। আর তিনি ভেতর থেকে তার সমালোচনা করলেন—তীব্র ও জরুরি স্বরে।

সহস্রাব্দের শুরুতে ভারতের নেতৃত্ব ও তার অন্যতম প্রশংসিত লেখিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলে গেল। দেশ ডানপন্থি হয়ে উঠল। হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি ও পরে স্বৈরাচারী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলেন। রায় দাঁড়ালেন বামপন্থি অবস্থানে। তিনি সাম্রাজ্যবাদ ও বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে লেখালেখি করলেন। ২০২৩ সালে কাশ্মির নিয়ে ২০১০ সালের মন্তব্যের জন্য ভারত সরকার তার বিরুদ্ধে মামলা করল। গত বছর তার বিরুদ্ধে বিস্তৃত সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অভিযোগ গৃহীত হলো; যা মোদি সরকার সমালোচকদের চুপ করাতে প্রায়ই ব্যবহার করে।

অসন্তুষ্টদের কাছে তিনি নায়ক। তিনি জীবনবাজি রেখে কথা বলেন। মোদির সমর্থকদের কাছে তিনি বিপজ্জনক, রাষ্ট্রবিরোধী ও হিন্দুবিরোধী। তিনি জাতীয় রাজনীতির খেলোয়াড় হয়ে উঠলেন, হয়ে উঠলেন বিশ্বাসের এক মানদণ্ড। তিনি আর কেবল উপন্যাসিক নন। তিনি শক্ত অবস্থান নেওয়া এক রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়াকে তিনি মুক্তির অনুভূতি হিসেবে দেখলেন।

রায়ের মতে, ‘এই খ্যাতি থেকে পালানো তার এক জীবনের অভ্যাস। শৈশব থেকেই তিনি শিখেছিলেন, স্থির থাকা নিরাপদ নয়। সবচেয়ে ভালো উপায় হলো চলতে থাকা। শৈশবে তার মা মেরি রায়ের প্রভাব ছিল গভীর ও জটিল। মেরি কেরালায় একটি প্রগতিশীল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্থানীয় শিশুদের, বিশেষ করে মেয়েদের, রক্ষণশীল নিয়ম ভাঙতে উৎসাহ দিতেন। তিনি তাদের ডানা দিলেন, মুক্ত করলেন,’ অরুন্ধতী লিখেছেন। মেরি সহকর্মীদের কাছে ছিলেন এক নেতা, কিন্তু তার ছোট্ট সিরিয়ান খ্রিস্টান সমাজে তিনি ছিলেন বিতর্কিত এক বিদ্রোহী। খ্রিস্টান নারীদের উত্তরাধিকার অধিকার আদায়ে তার লড়াই তাকে জাতীয় নারীবাদী আইকনে পরিণত করেছিল।

তবু অরুন্ধতীর চোখে মা ছিলেন একই সঙ্গে দানব। তিনি ছিলেন ক্রোধে ভরা এক ঝড়, যিনি মেয়েকে অবিরাম বকাঝকা করতেন এবং বলতেন : অরুন্ধতী তার জীবনের বোঝা। মেরি দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় ভুগতেন। হাঁপানিতে কষ্ট পেতেন। অরুন্ধতী মাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। ‘আমি তার জন্য শ্বাস নিতে চেয়েছি,’ তিনি লিখেছেন। ‘আমি তার ফুসফুস হয়েছি। তার দেহ হয়েছি। গোপনে তার অঙ্গ হয়ে গেছি : এক গোপন এজেন্ট, যিনি নিজের জীবন দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখে।’

১৬ বছর বয়সে তিনি প্রথম পালালেন। তিনি বাড়ি ছাড়লেন এবং দিল্লিতে স্থাপত্য পড়তে গেলেন। তিনি বেপরোয়া, ভবঘুরে ছাত্রজীবনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি একটি ভাঙাচোরা ছাদের ঘরে থাকতেন। সামান্য আয়ে জীবন চালাতেন। নিজের প্রথম নাম সুসান্না বাদ দিলেন। স্থাপত্য ছেড়ে স্ক্রিপ্ট রাইটিং শুরু করলেন। তবু মনে মনে উপন্যাস লেখার স্বপ্ন বুনছিলেন। কিন্তু আগে তাকে নিজের বহু ভাষার জগৎকে নিজের ভাষায় বর্ণনা করতে হতো। ‘আমি জানতাম, যদি আমি আমার নদীকে বর্ণনা করতে পারি, বৃষ্টি বর্ণনা করতে পারি, অনুভূতিকে এমনভাবে ধরতে পারি যে তুমি তা দেখতে, গন্ধ পেতে, ছুঁতে পার—তা হলেই আমি নিজেকে লেখক ভাবব,’ তিনি লিখেছেন।

প্রথম উপন্যাসের খসড়া শেষ করতে করতে তিনি স্থিতিশীল গৃহজীবনে প্রবেশ করেছিলেন। তার সঙ্গী প্রদীপ খসড়া পড়ে বুঝলেন : এটি তাদের জীবন পাল্টে দেবে। বইয়ের অভাবনীয় সাফল্য ও গণমাধ্যমের নজর তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করল। এরপর ১৯৯৮ সালে ডানপন্থি জোট ক্ষমতায় এলো। দেশ পাল্টে গেল। রায় অনুভব করলেন এক মতাদর্শিক অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে। তিনি আর নিরাপদ, আরামদায়ক জীবনে মানিয়ে নিতে পারলেন না। তিনি প্রদীপকে ছেড়ে চলে গেলেন। ‘যখন ব্যক্তিগত জীবন ভেঙে পড়ল, বাইরের বিশ্ব ভেতরে ঢুকে পড়ল,’ তিনি লিখেছেন। ‘অদ্ভুতভাবে, রাজনীতি ও ক্রোধই আমাকে টিকিয়ে রাখল।’

এক ঝড়ের মতো প্রবন্ধের ধারায় তিনি ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষার সরকারি যুক্তি খণ্ডালেন। দুর্নীতি ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করলেন। বড় বড় বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। তিনি প্রতিবাদেও অংশ নিলেন। নর্মদা নদীর বাঁধের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আদেশ চ্যালেঞ্জ করায় আদালত তাকে অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করলেন।

শিগগিরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিরুদ্ধেও মন্তব্য করলেন। তার প্রবন্ধ যেমন চেনাজানা হলো, তেমনি বিতর্কিতও হয়ে উঠল। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১-এর তিন সপ্তাহ পরে প্রকাশিত দ্য অ্যালজেব্রা অব ইনফিনিট জাস্টিস-এ তিনি হামলাকে ‘অমানবিক’ বললেন। কিন্তু তিনি প্রশ্ন তুললেন—জর্জ বুশ যে বলছেন, হামলাকারীরা আমেরিকার স্বাধীনতাকে ঘৃণা করে, তা কি সত্যি? তিনি লিখলেন, সিআইএর আফগানিস্তান নীতিই ওসামা বিন লাদেনকে গড়ে তুলেছিল। তিনি সতর্ক করলেন—অন্তহীন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বিশ্বকে ঠেলে দেওয়া বিপজ্জনক। সমালোচকরা তাকে ‘আমেরিকাবিরোধী’ বলল।

তবু কল্পকাহিনির টান তাকে ছাড়েনি। ২০১০ সালে মধ্য ভারতের মাওবাদী গেরিলাদের সঙ্গে ভ্রমণের সময় কল্পিত চরিত্রগুলো আবার তাকে ঘিরে ধরল। তিনি লিখলেন, এটি ছিল আশীর্বাদের মতো। কিন্তু সেই কল্পকাহিনিও নতুন রূপ নিল—আরও সরব, আরও রাজনৈতিক। প্রথম উপন্যাসের ২০ বছর পর ২০১৭ সালে প্রকাশিত দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস পাঠককে নিয়ে যায় দিল্লির এক কবরস্থানে। সেখানে সমাজের বাইরে থাকা মানুষদের ভিড়। আর নিয়ে গেল কাশ্মিরের অশান্ত ভূখণ্ডে। সরকারি চাপ থাকা সত্ত্বেও তিনি আবারও কাশ্মির লিখলেন।

রায় নিজে বলেন, তার বিশ্বদৃষ্টি এসেছে ভয় থেকে—‘আমার হৃদয়ের ঠান্ডা পতঙ্গ’—যা তিনি শৈশবে মায়ের সঙ্গে থাকতে শিখেছিলেন। সেই ভয়ই তাকে গড়ে তুলেছে। সেটাই তাকে বিশৃঙ্খল, বিদ্রোহী, কর্তৃত্ববিমুখ মানুষ বানিয়েছে। ২০২২ সালে মায়ের মৃত্যু তাকে দিশাহারা করে দেয়। তিনি লিখেছেন, তার জগতের মহাকর্ষীয় কেন্দ্র হারিয়ে গেছে। এখন ৬৩ বছর বয়সি রায় এখনও থাকেন সেই দেশে, যে দেশ একসময় তাকে উদযাপন করত, আর আজ তার মতপ্রকাশকে দমিয়ে রাখে। তিনি জানেন; এখন আর সহজ কোনো পালাবার পথ নেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়