দ্রুতগামী আধুনিক জীবনে উদ্বেগ, মানসিক চাপ ও অনিদ্রার মতো সমস্যায় ভুগছেন অসংখ্য মানুষ। তথ্য ও প্রযুক্তির সুলভ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মানসিক শান্তি আজ সবচেয়ে দুর্লভ বিষয়গুলোর একটি। এমন বাস্তবতায় প্রাচীন স্টোয়িক দার্শনিক মার্কাস অরেলিয়াস, ইপিকটিটাস ও সেনেকার জীবনদর্শন নতুন করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাদের পরামর্শ দেওয়া পাঁচটি সহজ দৈনন্দিন অভ্যাস আজও স্ট্রেস কমাতে এবং মনের গভীরে প্রশান্তি ফিরিয়ে আনতে কার্যকর। নিয়ন্ত্রণযোগ্য বিষয়গুলোতে মনোযোগ, মৃত্যুচিন্তা, প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলা, বাধাকে সুযোগ হিসেবে দেখা এবং জার্নাল করার মতো অভ্যাস মানসিক দৃঢ়তা গঠনে প্রমাণিতভাবে সহায়ক।
মানসিক চাপ এখন বৈশ্বিক সংকটের পর্যায়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে প্রায় ৩৫ কোটি ৯০ লাখ মানুষ উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভোগেন। ব্যস্ততা, তথ্যের অতিরিক্ত চাপ, প্রতিযোগিতা ও অনিশ্চয়তা মিলে মানসিক শান্তিকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তাই বাস্তবমুখী সমাধানের খোঁজে মানুষ আজ প্রাচীন দর্শনের দিকেই ফিরছে।
স্টোয়িক দর্শনের পাঁচটি চর্চা দীর্ঘ শতাব্দী ধরে মানুষের জীবনে শক্তির উৎস হয়ে এসেছে। মনোবিজ্ঞানের অন্যতম কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপির (CBT) শেকড়ও নিহিত রয়েছে এই দর্শনে।
নিচে তুলে ধরা হলো সেই পাঁচটি কার্যকর অভ্যাস।
যা নিয়ন্ত্রণে আছে, সেখানেই মনোযোগ
স্টোয়িক দর্শনের মূল ভিত্তি নিয়ন্ত্রণযোগ্য ও অ-নিয়ন্ত্রণযোগ্য বিষয় আলাদা করা। ইপিকটিটাস বলেন, মানুষ কষ্ট পায় কারণ সে এমন বিষয়েও উদ্বিগ্ন হয় যা তার নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রধানের আচরণ, ভালোবাসার প্রতিদান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা আকস্মিক মৃত্যু কারও হাতেই নেই।
মার্কাস অরেলিয়াস লিখেছেন, কোনো বাহ্যিক ঘটনা নয়, বরং সেই ঘটনাকে আমরা কীভাবে দেখি, সেটিই আমাদের কষ্টের কারণ। উদাহরণ হিসেবে ধরুন, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যদি স্বপ্নের চাকরি হারান, আপনি এটিকে দুর্ভাগ্য মনে করতে পারেন। আবার একই ঘটনাকে নতুন পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ হিসেবেও দেখতে পারেন।
দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনই স্ট্রেস কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
মৃত্যুচিন্তা: জীবনের আসল সত্যে ফেরার আহ্বান
মেমেন্তো মরি, অর্থাৎ মৃত্যুর কথা স্মরণ করা, স্টোয়িকদের অন্যতম চর্চা। মানুষ নশ্বর; এ সত্য উপলব্ধি করা অহেতুক ভয়, সন্দেহ ও উদ্বেগ দূর করে জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা বাড়ায়। ইপিকটিটাস বলেন, প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানোর সময় মনে রাখতে হবে, একদিন সবই শেষ হবে। এই উপলব্ধি মুহূর্তে শান্তি ও গ্রহণযোগ্যতা জাগায়।
স্টিভ জবসও বলেছিলেন, মৃত্যুর কথা মনে রাখা জীবনের বড় সিদ্ধান্ত নিতে অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার।
প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জীবন
স্টোয়িকদের মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাজ করে। গাছ নিজের দায়িত্ব পালন করে, পাখি গান গায়, মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে নিজের ভাবনা ও ভয়ের মাধ্যমে অশান্তির জন্ম দেয়।
মার্কাস অরেলিয়াস বলেন, সুখ নির্ভর করে চিন্তার গুণগত মানের ওপর। সত্য থেকে বিচ্যুত হলে ভয় জন্মায়, আর সত্য বলা ও সত্য মেনে চলা মানুষকে মুক্তি দেয়। খোলামেলা ও সৎ আচরণ দীর্ঘমেয়াদে মানসিক প্রশান্তি রক্ষা করে।
বাধাই পথ দেখায়
স্টোয়িকদের আরেক মূলমন্ত্র হলো, জীবনের বাধাই এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে। বিপর্যয়কে অনেকে ভাগ্যের দোষ বলে মনে করেন। কিন্তু স্টোয়িকরা জানেন, দৃষ্টিভঙ্গিই ভাগ্যকে পরিচালিত করে।
দুই ভাইয়ের গল্পটি এর বড় উদাহরণ। একজন মদের নেশায় ধ্বংস হওয়া বাবাকে অনুসরণ করে নিজেও নেশায় ডুবে যায়। আরেকজন একই বাস্তবতা দেখেই সিদ্ধান্ত নেয়, সে বাবার মতো হবে না। পরিশ্রম করে গড়ে তোলে সফল জীবন। একই ঘটনা, দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।
সেনেকা লিখেছেন, বারবার দুর্ভাগ্যই মানুষকে আরও দৃঢ় করে।
জার্নালিং বা কাছের মানুষের সঙ্গে কথা বলা
স্টোয়িক দার্শনিকরা নিয়মিত জার্নাল লিখতেন। মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা ভয় যখন কাগজে লেখা হয়, তখনই স্পষ্টতা আসে। ঠিক যেমন থেরাপিতে রোগী ভয়গুলো প্রকাশ করেই মানসিক চাপ কমাতে পারেন।
বিশ্বাসযোগ্য বন্ধুর সঙ্গে কথা বলাও একইভাবে স্বস্তি দেয়। সেনেকা বলেন, দিনের শেষে নিজের সব কাজ-ভাবনা খোলামেলা বিশ্লেষণ করাই শান্ত মন গঠনের পথ তৈরি করে।
নোটিফিকেশন, ব্যস্ততা ও তাড়াহুড়োর যুগে মানসিক চাপ অনিবার্য হলেও সমাধানের পথ আমাদের ভেতরেই আছে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো, মৃত্যুচিন্তা, প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলা, বাধাকে সুযোগ হিসেবে দেখা এবং জার্নালিংয়ের মতো সহজ অভ্যাস স্ট্রেস কমিয়ে মানসিক স্থিতি ফিরিয়ে আনে।
সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ