বিশ্বের জনপ্রিয় লেখদের একজন সারা হার্ভি। তিনি ‘কাইজেন: জাপানিস সিক্রেট টু লাস্টিং চেঞ্জ’ বইয়ের লেখক। টোকিওতে থাকার সময় জাপানি সংস্কৃতির প্রতি মুগ্ধ হয়ে তিনি এই দর্শনগুলো নিজের জীবনে প্রয়োগ করেন। বর্তমানে তিনি লন্ডনে সাহিত্য পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে তিনি জাপানিদের অর্থ সঞ্চয়ের কাকেবো পদ্ধতি তুলে ধরেন।
লেখিকা জানান, তিনি ২০২৭ সালে লন্ডনের এক প্রকাশনা সংস্থার চাকরি ছেড়ে জাপানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ জাপানের সংস্কৃতি তার ভালো লাগে আর সে সময় নতুন কিছু করার কথা ভাবছিলেন। সারা বলেন, আমি জাপানে চলে যাই, টোকিওতে ছয় মাস থাকার পর বুঝলাম, জাপানি জীবনে ছোটখাটো বিষয়, সচেতনতা আর ধীরে ধীরে পরিবর্তনের ওপর কতটা গুরুত্ব দেয়া হয়। এখানকার জীবনযাপন আমার দৃষ্টিভঙ্গি পুরোই পাল্টে দিল। বিশেষ করে, আমি বুঝলাম আমার অপ্রয়োজনীয় আর আবেগপ্রবণ খরচের অভ্যাস ঠিক কতটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।ঠিক তখনই আমি শুনলাম এক জাপানি বাজেটিং পদ্ধতির কথা, যেটাকে বলা হয় ‘কাকেবো’ মানে হলো ‘পরিবারের হিসাবের খাতা’। শুনে আগ্রহ জন্মাল, আর আমি ঠিক করলাম এটা নিজে চেষ্টা করব।
কাকেবো: অর্থ সঞ্চয়ের শতবর্ষী জাপানি পদ্ধতি ‘কাকেবো’। এটি আবিষ্কার করেছিলেন ১৯০৪ সালে হানি মটোকো, যিনি জাপানের প্রথম নারী সাংবাদিক হিসেবেও পরিচিত। উদ্দেশ ছিল নিজের আয় ও ব্যয়ের সম্পর্কটা ভালোভাবে বোঝা, এবং সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া। এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে কোনও অ্যাপ, সফটওয়্যার বা এক্সেল শিটের দরকার হয় না। শুধু একটা খাতা ও কলম ঠিক যেন এক ধরনের ‘অর্থনৈতিক মেডিটেশন’।
গবেষণায় দেখা গেছে, হাতে লিখে হিসাব রাখা মানসিকভাবে উপস্থিতি বাড়ায়, আত্মনিয়ন্ত্রণ গড়ে তোলে এবং খারাপ অভ্যাসগুলো বুঝতে সাহায্য করে। কাকেইবোও ঠিক সেটাই করে তোমার খরচের পেছনের মানসিক কারণগুলো সামনে আনে। কাকেবো শেখায়, খরচের আগে নিজেকে কিছু প্রশ্ন করো।
কোনো কিছু কেনার আগে কাকেবো পদ্ধতি অনুযায়ী নিজেকে নিচের প্রশ্নগুলো করা জরুরি:
আমি কি এই জিনিস ছাড়া বাঁচতে পারি না?
আমার বর্তমান আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী এটি কেনা ঠিক হবে?
আমি কি সত্যিই এটা ব্যবহার করব?
বাড়িতে এর জন্য জায়গা আছে কি?
আমি এটা কীভাবে দেখলাম বা জানলাম, কোনও বিজ্ঞাপন, দোকান, না কি সোশ্যাল মিডিয়া?
আজ আমার মানসিক অবস্থা কেমন? (খুশি, চাপগ্রস্ত, না কি মন খারাপ?)
এটা কেনার চিন্তায় আমি কেমন অনুভব করছি, এবং এই অনুভূতি কতক্ষণ থাকবে?
লেখিকা বলেন, এই প্রশ্নগুলো আমার কেনাকাটার সিদ্ধান্তে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছিল। আমি বুঝতে পারলাম, আসলে কোনটা ‘চাওয়া’ আর কোনটা ‘প্রয়োজন’। ফলাফল হিসেবে আমি দ্রুত, যৌক্তিক ও বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করি।
মাইন্ডফুল খরচ ও সঞ্চয়: সারা বলেন, কাকেবো আমাকে শুধু খরচ কমাতে সাহায্য করেনি, বরং অর্থের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও সচেতন ও মানবিক করে তুলেছে। এই পদ্ধতি কখনোই বলে না যে জীবনের আনন্দ কেটে ফেলতে হবে। বরং শেখায় ছোট ছোট পরিবর্তন আনা, নিজের অভ্যাস বুঝে ধীরে ধীরে বদলানো। যেমন, মন খারাপ থাকলে একটা ফুল কেনা কোনও অপরাধ নয়; বরং এটি মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
কাকেবো থেকে শেখা ৬টি বাস্তব পরামর্শ
১️. ২৪ ঘণ্টা নিয়ম: অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার আগে একদিন অপেক্ষা করা। যদি পরদিনও দরকার মনে হয়, তখনই কেনা।
২️. সেলের ফাঁদে পা না দেয়া: ভাবুন যেটা সেলে কিনতে চাইছেন সেটা কি পুরো মূল্য দিয়ে কখনও কিনতেন?
৩️. ব্যাংক ব্যালান্স নিয়মিত দেখা: প্রতিদিনের হিসাব জানা থাকলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়।
৪️. ক্যাশে খরচ করা: নগদ অর্থ হাতে গেলে খরচের চাপ বেশি অনুভূত হয়, আর বাজেট মেনে চলা সহজ হয়।
৫️. মানিব্যাগে সতর্কবার্তা রাখা: যেমন, কার্ডে ছোট একটা বার্তা যাতে লেখা থাকবে ‘‘এটা কি সত্যিই এটা দরকার?”
৬️. যে পরিবেশে খরচ বাড়ে, সেটি বদলানো: মার্কেটিং ইমেল, ইনফ্লুয়েন্সার বা অনলাইন শপিং লোভ জাগালে আনসাবস্ক্রাইব বা আনফলো করো।
এই ছোট ছোট পরিবর্তন সাধারণ মনে হলেও এটা সঞ্চয় বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে। সাধারণ সঞ্চয়ের থেকে কাকেবো মেনে চললে অর্থ জমানোর পরিমাণ কিছুটা হলেও বাড়বে। অপ্রয়োজনীয় খরচ বন্ধ হলে সঞ্চয় করা সহজ হবে। তাই যদি আপনি সঞ্চয় করতে চাইলেও মাস শেষে ব্যয় নিয়ে চিন্তায় থাকেন তাহলে আজ থেকে মানতে পারেন কাকেবো পদ্ধতিটি।