সিএনএন খ্যাত সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়া বলেছেন, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে হামলার নির্দেশনা দিয়েছেন তা অপ্রত্যাশিত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন কারণ তিনি কখনো চাননি ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখুক। বিষয়টি নিয়ে সবসময় তিনি ভয় পেতেন। সিএনএনের সাংবাদিক অ্যান্ডারসন কুপারের কাছে তিনি এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
ফরিদ জাকারিয়া বলেন, গত কয়েক সপ্তাহে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দু’টি বিষয়ে তার নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। একটি হচ্ছে ইরান পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির কিছু অংশ রাখতে পারে যা পর্যবেক্ষণে থাকবে। কিন্তু ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে ইসরাইলের পক্ষে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করলেন, তার মানে ‘জিরো ইনরিচমেন্ট’ বা ইরান কোনো পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি রাখতে পারবে না। এ জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দুই সপ্তাহ সময় বেঁধে দিলেন ইরানকে। দ্বিতীয়বারের মতো ট্রাম্প আন্তরিকভাবেই নিজের অবস্থান ফের পরিবর্তন করলেন ইরানের সাথে বিষয়টি নিয়ে দরকষাকষির ব্যাপারে। এ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দেখে মনে হয়েছে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছেন। কারণ এটি তার প্রথম পছন্দ ছিল না। তার প্রথম পছন্দ ছিল ইরানের সাথে পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখা। কিন্তু ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের ব্যাপারেই ঝুঁকলেন যা ইরান কখনোই মেনে নেবে না। আমার মনে হয় ট্রাম্প ভাবলেন ইরান এ দরকষাকষিতে আন্তরিক নয়। এর ফলাফলেই হঠাৎ করে ইরানে আক্রমণ করে তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়া হলো প্রায় পুরো পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি।
ফরিদ জাকারিয়া বলেন, প্রশ্ন হচ্ছে এখনো কূটনীতির প্রয়োজন রয়ে গেছে এবং ইরানের সাথে এ সঙ্কট নিরসনে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই প্রয়োজন। কারণ ইরান ফের এ ধরনের পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করতে পারবে। মনে রাখতে হবে ইরানিরা এমন একটি জাতি যারা গত সত্তর বছর ধরে এ ধরনের কর্মসূচি অব্যাহতভাবে চালিয়ে আসছে। ইরানে পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু হয়েছিল শাহের আমলে। যত কঠিন হোক না কেন কয়েক বছর লাগবে তাদের এ পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করতে। এখন ট্রাম্প যতই ইরানের সাথে এ ব্যাপারে চুক্তি করতে চান না কেন ইরান তা করতে চাইবে না। ট্রাম্প যদিও বলছেন, এটা শান্তির সময় কিন্তু তারা চুক্তির জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। আলোচনার বাইরে ইরানের হাতে তেমন বেশি সুযোগ না থাকলেও ইরানিরা একগুঁয়ে, কঠোর জাতীয়তাবাদী, গর্বিত জনগোষ্ঠী। খুবই আদর্শবাদী। তাহলে এখন মূল কথা হচ্ছে ইরানিরা এখন তাদের এই বিধ্বংসী বিপর্যয়কে কিভাবে দেখবে? তারা কি ট্রাম্প ও ইসরাইলি শর্ত মেনে নেবে পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির ব্যাপারে, জিরো ইনরিচমেন্ট নাকি ফের এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করবে।
এদিকে পলিটিকোর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে হোয়াইট হাউজ ইরানে হামলার পর পাল্টা হামলার আশঙ্কা করছে। আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তান, সিরিয়া, কুয়েত ও লেবাননে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন, রায়ান ক্রোকার। তিনি বলেন, ইরানের সামনে এখন দু’টি পথ খোলা, হয় পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি ধরে রাখার জন্য আলোচনায় ফিরে আসা, অথবা প্রতিশোধ নেয়া। ইরানের প্রতিশোধের মধ্যে হরমুজ প্রণালী অবরোধ, আরব উপসাগরের জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর আক্রমণ অথবা সরাসরি বা সহযোগী মিলিশিয়াদের মাধ্যমে এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ও কূটনৈতিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ হতে পারে।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির বিশিষ্ট ফেলো এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রাক্তন মার্কিন বিশেষ দূত ডেনিস রস বলেন, আমেরিকা ফের ইরানের অন্য কোনও স্থানে আঘাত না করলে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে। ইরানের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্য মাথায় রেখে যদি ব্যাপক বোমা হামলা করে যুক্তরাষ্ট্র তাহলে আমাদেরকেও ভারী মূল্য দিতে হবে।
ইউরেশিয়া গ্রুপের সভাপতি ইয়ান ব্রেমার বলেন, ‘যুদ্ধ শেষ করার চেয়ে তা শুরু করা অনেক সহজ। এখন পর্যন্ত, ইরানি নেতৃত্ব উল্লেখযোগ্য সংযম প্রদর্শন করেছে। তারা কেবল ইসরাইলের বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত করছে। এর অর্থ হলো ইরানি নেতৃত্ব সমন্বিত রয়েছে এবং হতাশা থেকে কাজ করছে না।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র ফেলো রে তাকে বলেন, ইরানে বোমা হামলা এই সঙ্ঘাতের শেষ সমাধান নয়।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবার্ট এ পেপ বলেন, ইরানে হামলার পর তারা মার্কিন স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানতে পারে যা তাদের ক্ষেপণাস্ত্র থেকে দশ মিনিট সময়ের দূরত্বে অবস্থিত।
মার্কিন পররাষ্ট্র বিশ্লেষক ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক একাধিক বইয়ের লেখক রবিন রাইট বলেন, ভয়ঙ্কর বিপদ হলো যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইল কেউই ইরানের ওপর তাদের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য কী তা স্পষ্টভাবে বিশদভাবে জানায়নি। নিঃসন্দেহে ইরান এই যুদ্ধ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। তবে এটি টেক্সাসের দ্বিগুণেরও বেশি - গাজার বিপরীতে, যা বৃহত্তর ফিলাডেলফিয়ার আকার। ২০ মাস যুদ্ধের পরও ইসরাইল সেখানে যুদ্ধে লিপ্ত। ইরান আফগানিস্তানের দ্বিগুণ আকারের, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘতম যুদ্ধ করেছিল। এবং এটি ইরাকের তিনগুণ আয়তনের, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আট বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়েছিল, যার ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে আইসিসের জন্ম হয়েছিল, একটি চরমপন্থী আন্দোলন যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইরাকে ফের যোগদান করতে বাধ্য করেছিল। সৈন্যরা এখনো সেখানে রয়েছে। সাম্প্রতিক অনেক নজির এবং শিক্ষা রয়েছে যা ওয়াশিংটনের আগামী ঘণ্টা, দিন এবং সপ্তাহগুলোতে কী করবে তা নেভিগেট করার সময় মনোযোগ দেয়া উচিত।