মহসিন কবির: বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মানছেন না নির্বাচনী আচরণবিধি। সেজন্য কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ছোট রাজনৈতিক দলের নেতারা। প্রয়োজনে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বড় দলের প্রার্থীদের আচরণবিধি মানানোর ক্ষেত্রে অতীতে নির্বাচন কমিশনের গাফিলতি লক্ষ্য করা গেছে। পাশাপাশি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার এবং নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনতে সব প্রার্থীকে এক মঞ্চে ইশতেহার ঘোষণার আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রচারে যানবাহনের শোডাউন বন্ধের দাবি করেন তারা। গতকাল সোমবার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপের তৃতীয় দিনে বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলোর নেতারা এসব দাবি জানান।
সংলাপের শুরুতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা না পেলে ভোট ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হতে পারে। আগামী নির্বাচন নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও সেসব মোকাবিলায় ইসি প্রস্তুত রয়েছে। একটা সুষ্ঠু-সুন্দর নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ইসি চেষ্টা করে যাবে। আমাদের নিয়ত এবং কমিটমেন্ট পরিষ্কার। সেভাবেই কাজ চলছে। যত ঝঞ্ঝা, সাইক্লোন, ঝড় আসুক না কেনÑ আমরা এসব মোকাবিলা করে একটা সুষ্ঠু-সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিতে যত পদক্ষেপ দরকার সব নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন।
সংলাপের তৃতীয় দিনে গতকাল সকালের পর্বে অংশ নেয় বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি এবং বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল। এ পর্বে মুক্তিজোটের আবু লায়েস মুন্না, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির আব্দুর রহমান, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের আব্দুল মান্নান, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মো. ইব্রাহীমকে বিএমএলের নজরুল ইসলাম বুলবুলের নেতৃত্বে প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।
সিইসি বলেন, অনেকগুলো নতুন, বড় ও জটিল কাজ আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এর আগে বলছিলাম, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জাহাজের নাবিকের মতো আমরা স্টিয়ারিং ধরে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নানা সমস্যা মোকাবিলা করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও যত চ্যালেঞ্জ আসুক, মোকাবিলার জন্য ইসি প্রস্তুত এবং এগুলোকে উতরেই এগোতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন।
এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, আচরণবিধি প্রতিপালনের লক্ষ্যে দলগুলোর সহায়তাই মূল লক্ষ্য। এই সহযোগিতা ছাড়া সুন্দর নির্বাচন করা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলো না চাইলে এবং তারা যদি সমস্যা সৃষ্টি করতে চায়Ñ তা হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। সংলাপ নিয়ে তিনি বলেন, এটা একটা রেওয়াজের অংশ। সব সময় জাতীয় নির্বাচনের আগে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। এর মধ্যে প্রধান অংশীজন রাজনৈতিক দল। দেশটা আমাদের সবার। আর সুন্দর দেশ গড়তে প্রাথমিক শর্তটা হচ্ছে একটা সুন্দর নির্বাচন। এর মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারলে দেশের জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হতে পারে।
সংলাপে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে ৫ আগস্ট লুট হওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধারে? ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায়।
বড় দুটি দলের বিষয়ে আচরণবিধি না মানার আশঙ্কা প্রকাশ করে বিকল্পধারা এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রার্থির প্রার্থিতা বাতিলের দাবি করে। একই সঙ্গে কোনো দলের এজেন্টকে ভোট কেন্দ্রে থাকতে না দেওয়ার বিষয়টি আচরণবিধিতে সংযুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। এ ছাড়া ইসির পূর্ণ ক্ষমতা বাস্তবায়নের পাশাপাশি পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোটার? তালিকা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় করার দাবি জানায় বিকল্পধারা।
আচরণবিধি লঙ্ঘন রোধে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি গণমাধ্যমের সহযোগিতা এবং রিটার্নিং কর্মকর্তা কর্তৃক তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়। এ ছাড়া নির্বাচনী এজেন্টদের ভোটের আগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং ফেক চেকিং ও এআই ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানায় দলটি।
বাংলাদেশ মুসলিম লীগ দাবি করে, প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র সাবমিটের পরই তার নির্বাচনী এজেন্টদের তালিকা দিতে হবে। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, অবৈধ ও কালো টাকার ব্যবহার এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার রোধ করারও দাবি জানায় দলটি।
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট সব দলের প্রার্থীকে এক?মঞ্চে ইশতেহার ঘোষণার ব্যবস্থা করার আহ্বান জানায়। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা বাড়াতে স্বরাষ্ট্র এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সরাসরি ইসির অধীনে আনা, দ্বৈত নাগরিকত্ব বাতিল করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ আরপিওতে সংযুক্ত করা এবং যানবাহনে নির্বাচনী প্রচার বা শোডাউন নিষিদ্ধের প্রস্তাব করে দলটি।
এদিকে কল্যাণ পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান হিসেবে সৈয়দ মো. ইব্রাহীমকে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) সংলাপে আমন্ত্রণ জানানোয় প্রতিবাদ জানিয়েছে ১২ দলীয় জোট। জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, নির্বাচন কমিশনের চলমান সংলাপে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর এবং ডামি নির্বাচনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির একাংশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
এই আমন্ত্রণ এমন এক রাজনৈতিক পরিবেশকে বৈধতা দেয়, যা দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরাচারী শাসনকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এটি জনগণের প্রত্যাশা ও গণতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে যেসব দল বা সংগঠন স্বৈরাচারী শক্তির সহযোগী হিসেবে পরিচিত, তাদেরকে সংলাপে অন্তর্ভুক্ত করা একটি ভুল রাজনৈতিক বার্তা দেয় এবং এটা জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের পরিপন্থি।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, যেসব দল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, মানবাধিকার এবং জনগণের ভোটাধিকার সুরক্ষায় নির্ভরযোগ্য ভূমিকা রাখে নাÑ তাদের অযৌক্তিক অংশগ্রহণ অবিলম্বে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। কমিশনকে গণমানুষের আস্থাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। গণতন্ত্র নিয়ে ছলচাতুরী নয়, বরং জনগণের কণ্ঠস্বরকে সত্যিকারভাবে প্রতিনিধিত্ব করার জন্যই সংলাপ হওয়া উচিত। অন্যথায় সংলাপ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আমরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দৃঢ়প্রতিবাদ জানাই এবং গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে সব নাগরিকের সংহতি কামনা করি।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের ধারাবাহিকতায় আগামীকাল বুধবার বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আলোচনায় বসছে নির্বাচন কমিশন। একই দিন নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্ট- এনসিপি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলকেও (মার্কসবাদী) ডাকা হয়েছে। গতকাল ইসির জনসংযোগ শাখার সহকারী পরিচালক মো. আশাদুল হক এ তথ্য জানান। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার, রবিবার, সোমবার ও বুধবার- চার দিনে ৪৮টি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। নতুন দুটি দল নিয়ে বর্তমানে ৫৫টি নিবন্ধিত দল রয়েছে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত ও তিনটি দলের নিবন্ধন বাতিল রয়েছে।
ইসির জনসংযোগ শাখা বলছে, বুধবার সকালের পর্বে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি- বিএজেএমপি, ইনসানিয়াত বিপ্লব, জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন- এনডিএম। আর দুপুর ২টা থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, গণঅধিকার পরিষদ- জিওপি, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ রিপাবলিকান পাটি- বিআরপি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্কসবাদী) সঙ্গে সংলাপে বসবে নির্বাচন কমিশন।