বাংলাদেশের মোট মোজারেলা পনিরের প্রায় ৭০ শতাংশই এখন ঠাকুরগাঁওয়ে উৎপাদিত হয়। সেখানে গত বছর কারখানার সংখ্যা ছিল ৩৩টি, যা এ বছর বেড়ে ৩৮টিতে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ দুগ্ধ উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোতে বাতাসে ভেসে আসা গরম দুধের মিষ্টি ঘ্রাণ এক অপ্রত্যাশিত কিছুর জানিয়ে দিচ্ছে: একটি দ্রুত বর্ধনশীল 'পনির বিপ্লব', যার নেতৃত্বে আছেন এমন সব উদ্যোক্তা—যারা টিনের ছাদের ঘর, পরিত্যক্ত গুদাম কিংবা গ্রামের রান্নাঘরে বসেই কাজ করছেন।
ছোট একটি পরীক্ষা হিসেবে শুরু হওয়া এই উদ্যোগটি আজ নারীদের হাত ধরে নীরবে একটি সমৃদ্ধ শিল্পে পরিণত হচ্ছে। তারা স্থানীয় দুধ দিয়ে মোজারেলা পনির তৈরি করছেন, যা শুধু দেশের পিৎজার দোকান বা ফাস্ট ফুড চেইনের চাহিদাই মেটাচ্ছে না, বরং বিদেশি ক্রেতাদেরও আকৃষ্ট করছে।
একজন তরুণ উদ্যোক্তার উত্থান
মাত্র কয়েক মাস আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হেদায়েতুল ইসলাম বেসরকারি চাকরি ছেড়ে বগুড়ার কলোনি এলাকায় একটি ছোট পনির তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। ২০২৪ সালে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়ার পর প্রথম তার মাথায় এই ধারণাটি আসে।
হেদায়েত বলেন, 'প্রতিবেদনটি পড়ার পর আমি পনিরের বিশাল ও ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বুঝতে পারি। তাই আমি দক্ষ ডেইরি টেকনিশিয়ান খুঁজে বের করি এবং নিজেই তাদের কাছে প্রশিক্ষণ নিই। আমি ইতোমধ্যে আড়াই লাখ টাকারও বেশি বিনিয়োগ করেছি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী।'
হেদায়েত এখন আশপাশের বাজারগুলোতে মোজারেলা পনির বিক্রি করছেন এবং রপ্তানিযোগ্য পনির তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য একটি আদর্শ বাজার
দেশের পনিরের বাজার—যা একসময় পুরোপুরি আমদানিনির্ভর ছিল—এখন সেখানে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের আগ্রহের জোয়ার দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মোট মোজারেলা পনিরের প্রায় ৭০ শতাংশই এখন ঠাকুরগাঁওয়ে উৎপাদিত হয়। সেখানে গত বছর কারখানার সংখ্যা ছিল ৩৩টি, যা এ বছর বেড়ে ৩৮টিতে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি কারখানা ইতোমধ্যে 'ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন' (আইএসও) সনদ অর্জন করেছে।
দুগ্ধজাত পণ্যের নতুন উদ্যোগে সহায়তাকারী উন্নয়ন সংস্থা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) জানিয়েছে, শুধুমাত্র ২০২৩ সাল থেকেই বগুড়ায় ৮টি, সিরাজগঞ্জে ১১টি এবং নওগাঁয় ২টি পনিরের কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া ভোলা, চুয়াডাঙ্গা ও চট্টগ্রামেও বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে।
পিকেএসএফ-এর একজন প্রতিনিধি বলেন, 'দেশ ও বিদেশে পনিরের চাহিদা বাড়ছে। একারণেই অনেক উদ্যোক্তা পনির উৎপাদনে এগিয়ে আসছেন।'
গৃহিণী থেকে পুরস্কারজয়ী পনির নির্মাতা
ঠাকুরগাঁওয়ের পনির শিল্পের যদি কোনো প্রতিচ্ছবি বা মুখ থাকে, তবে তিনি নিশ্চিন্তপুরের মাসুমা খানম—একজন গৃহিণী, যিনি ভাড়ার জায়গায় ছোট পরিসরে কাজ শুরু করেছিলেন এবং এখন ঠাকুরগাঁও, বগুড়া ও পাবনা জুড়ে তিনটি কারখানার মালিক।
তার পুত্রবধূ সানজানা জাফরিন পনির প্রস্তুতির কাজ দেখাশোনা করেন, আর মাসুমা বাড়ি থেকেই উৎপাদন কার্যক্রম তদারকি করেন। মাসুমা বলেন, 'আমাদের প্রতিদিন কয়েক হাজার লিটার দুধ লাগে। প্রতিটি কারখানায় অন্তত ১০০ কেজি পনির উৎপাদিত হয়।'
ছয় মাস আগে মাসুমা একটি স্থানীয় এনজিওর মাধ্যমে বিদেশে পনির রপ্তানি করেন—যা তার এই গ্রামীণ ব্যবসার জন্য একটি বড় মাইলফলক। তার কারখানাগুলোতে এখন অন্তত ২০ জন নারী কাজ করছেন এবং এই ব্যবসা পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছে।
তিনি বলেন, 'আগে ছানার পানি ফেলে দেওয়া হতো, যা পরিবেশ দূষণ করত। এখন তা দিয়ে ঘি, বাটারমিল্ক ও লাবাং তৈরি করা হয়। বর্জ্য এখন সম্পদে পরিণত হয়েছে।' এই সাফল্যের সুবাদে তিনি ঠাকুরগাঁও শহরে একাধিক জমি কিনতে পেরেছেন।
পনির শিল্পের বিকাশের কেন্দ্রবিন্দুতে নারীরা
ঠাকুরগাঁওয়ের পনির উৎপাদনকারী অঞ্চলজুড়ে নারীরাই এই উৎপাদন ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। জেলার কারখানাগুলোতে ৪০০ জনেরও বেশি শ্রমিক সরাসরি কাজ করছেন। তারা সম্মিলিতভাবে প্রতিদিন ৫,০০০ কেজির বেশি পনির, ৩০০ কেজি ঘি এবং ৩,০০০ কেজি বাটারমিল্ক উৎপাদন করছেন।
এমনই একজন উদ্যোক্তা মুক্তা আক্তার, যিনি তার স্বামী জাহাঙ্গীর আলমের কাছ থেকে পনির তৈরির কাজ শিখেছেন। তাদের কারখানায় প্রতিদিন প্রায় ২০০ কেজি পনির উৎপাদিত হয়। মুক্তা বলেন, 'আমরা অনেক সময় উৎপাদন শুরুর আগেই অর্ডার পেয়ে যাই। চাহিদা এতটাই বেশি।'
কারখানায় ১২ জন কর্মী কাজ করছেন এবং তার স্বামী ঢাকায় পণ্য বাজারজাত করছেন। মুক্তা বলেন, নিরাপত্তা ও নিয়ম মেনে কাজ করলে ঘরে বসে পনির উৎপাদন নারীদের জন্য একটি আদর্শ পেশা।
দাতা সংস্থা ও সরকারের সহায়তা
বাংলাদেশের দুগ্ধ খাতের এই রূপান্তর কিন্তু এমনি এমনি ঘটছে না। ইফাদ, পিকেএসএফ এবং ডেনমার্কের ডানিডা-এর অর্থায়নে পরিচালিত 'রুরাল মাইক্রোএন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট (আরএমটিপি)' ১২টি জেলায় পনির, ঘি, লাবাং ও অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে কাজ করছে।
আরএমটিপির লাইভস্টক ভ্যালু চেইন বিশেষজ্ঞ এস এম ফারুক-উল-আলমের মতে, বাংলাদেশে বছরে গড়ে ১১.৫ টন পনির উৎপাদিত হয়। কিন্তু প্রতি বছর প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পনির আমদানি করা হয়।
তবে এখন রপ্তানিও ধীরে ধীরে বাড়ছে। ২০২৩ সালে ১৭ হাজার ৬৫২ ডলার মূল্যের পনির বিদেশে পাঠানো হয়েছে, যার বড় অংশই গেছে দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা ও ভারতে।
তিনি বলেন, 'প্রতি তিন মাসে আমরা শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই ১.৫ টন পনির পাঠাই।' দেশের বাজারে ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁগুলোতে মোজারেলা পনির প্রতি কেজি প্রায় ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়।
নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তারা মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করছেন
সস্তা ও সহজলভ্য দুধ আবদুস সামাদের মতো নতুন উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের একজন স্নাতক। মহামারির সময় তিনি ঢাকা ছেড়ে মেহেরপুরে চলে যান এবং ছোট পরিসরে দইয়ের ব্যবসা শুরু করেন, যা পরে পনির তৈরিতে সম্প্রসারিত হয়।
সামাদ বলেন, 'আমার লক্ষ্য আন্তর্জাতিক মানের পনির উৎপাদন করা। আমি এমন একটি রেস্তোরাঁ চালু করতে চাই, যেখানে চিজবার্গার ও চিজ পরোটার মতো খাবার থাকবে—যা পণ্যের মান ও দাম বাড়াতে সহায়তা করবে।'
পিকেএসএফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের বলেন, তাদের প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ঠিক এটাই: কৃষিখাতে পণ্যের মূল্য সংযোজন। তিনি বলেন, 'দুধ থেকে এখন অন্তত ১১ ধরনের পণ্য তৈরি হচ্ছে—যেমন পনির, ঘি, লাবাং এবং আরও অনেক কিছু।'
কাদের বলেন, 'আগে শুধু মিষ্টির দোকানগুলোই দুধ কিনত। এখন অনেক ধরনের ক্রেতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে কর্মসংস্থানের একটি ধারাবাহিক প্রবাহ সৃষ্টি হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা প্রযুক্তি হস্তান্তর, সনদপ্রাপ্তি, অর্থায়ন এবং বিপণনের মাধ্যমে উৎপাদকদের সহায়তা করছি।' তিনি বলেন, 'আমরা ঠাকুরগাঁওয়ে পনির দিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম; এখন তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ একে অপরের দেখে শিখছে। এটিই আসলে ব্যবসার প্রকৃত সমাধান।'
এই গতি যদি অব্যাহত থাকে, তবে ঠাকুরগাঁও বা বগুড়ার মোজারেলা পনির হয়তো শিগগিরই বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের চা বা তৈরি পোশাকের মতোই পরিচিত হয়ে উঠবে। এটি প্রমাণ করে, ছোট স্বপ্ন এবং সাধারণ উপাদান দিয়েও আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।
সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড