আদাবরে এক প্রেমিক যুগলকে অপহরণ করে মুক্তিপণ নিতে চেয়েছিল কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীরা। তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে হামলার শিকার হয় আদাবর থানা-পুলিশ। এতে তিন পুলিশ আহত হন। এই ঘটনার পর পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনী ওই এলাকায় অভিযান চালায়। রাতের মধ্যে শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করে। তাদের মধ্যে ৫ জনকে পুলিশের ওপর হামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, বাকিদের মোবাইল কোর্টে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
গতকাল সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর বেড়িবাধ সংলগ্ন আদাবরের শ্যামলী হাউজিংয়ের ৩ নম্বর সড়কে এই হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় আদাবর থানার কনস্টেবল ও গাড়িচালক আল আমিন, কনস্টেবল রায়হান ও নাজমুল আহত হন। তাদের মধ্যে কনস্টেবল আল আমিনের আঘাত গুরুতর। তিনি জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) এ চিকিৎসাধীন।
সোমবার রাতে যা ঘটেছিল
শ্যামলী হাউজিংয়ের ৩ নম্বর সড়কের ২১৫/১৬ নম্বর তিন তলা বাড়ি। এটি গাবতলী ও সদরঘাট বেড়িবাধ সংলগ্ন। এলাকাটি বালুরমাঠ হিসেবে পরিচিত। বাড়ির মালিক শহীদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি সেখানে থাকেন না। মো. মিলন ও তার স্ত্রী তাহমিনা বেগম বাড়িটির দেখাশোনা করেন। বাড়িটির নীচতলা থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত ছোট ছোট ৪৬টি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে নিম্মআয়ের মানুষ ভাড়া থাকেন। তেমনি একটি পরিবার ভবনটির তৃতীয় তলায় তাদের এক ষোড়শী মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকেন। মেয়েকে বাসায় রেখে ওই তরুনীর বাবা-মা তাদের উত্তরবঙ্গের বাড়িতে যায়। বাবা–মার অনুপস্থিতিতে ওই তরুনীর প্রেমিক পলাশ বাসায় আসেন। বিষয়টি টের পেয়ে যায় স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তারা ওই বাড়িতে ঢুকে তরুনী ও তরুণের ছবি তোলে, ভিডিও করে। তরুণকে মারধর করে। সন্ত্রাসীরা শ্লীতাহানীর চেষ্টা করে তরুণীর। কিছুক্ষণ পর ছেলে বন্ধু পলাশকে নিয়ে চলে যায় তারা।
বাড়িটির ম্যানেজার মিলনের স্ত্রী তাহমিনা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মেয়ে ও ছেলের প্রেমের সম্পর্ক। বিষয়টি জানে তাদের পরিবার। বিয়ে হওয়ার কথা রয়েছে। ছেলে কখন এই বাড়িতে ঢুকছে, তা তাঁরা টের পায়নি। তবে পরে জানতে পেরেছি, তাঁকে ধরে নিয়ে যায়।’
পলাশকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ধরে নিয়ে পাশের আরেকটি বাড়ির তৃতীয় তলার ছাদে নিয়ে যায়। এই বাড়িটি মূলত কিশোর গ্যাংয়ের আস্তানা। এই বাড়ির মালিক মালেক নামে এক ব্যক্তি। তিন তলার বাড়ির নিচতলায় রিকশার গ্যারেজ। এই গ্যারেজে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সারাদিন আড্ডা দেয়। মাকদ বিক্রি করে এবং মাদক রাখে।
সরজমিনে মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে, এলাকার সব দোকান বন্ধ। সড়কে পরে আছে ছোপ ছোপ রক্ত। কেউ ভয়তে মুখ খুলতে চাচ্ছে না। পুরো এলাকায় আতঙ্ক। পলাশকে যেখানে আটকে রাখা হয় সেটি লম্বা একটি বাড়ি। এই জমির মালিক স্থানীয় কাসেম নামের এক ব্যক্তি। তার কাছ থেকে মালেক নামে একজন মাটি ভাড়া নিয়ে ইটের ঘর তুলে রিকশার গ্যারেজ, দোকান ও বাসাবাড়ি তৈরি করেছেন। এই ভবনটির সামনে রয়েছে আরও একটি ইটের তৈরি তিনতলা ভবন। সেটির নীচেও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার গ্যারেজ। সেই গ্যারেজ ও ভবনের মালিক মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তি। দুই ভবনের সরুপথে দিনের বেলাতেও অন্ধোকার। সেখানে নিয়েই পলাশকে প্রথমে মালেকের গ্যারেজে নিয়ে আটকায়। পরে ভবনের তৃতীয় তলার ছাদে ওঠানো হয় তাকে। পলাশ ও তার পরিবারের কাছ থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মোটা অংকের টাকা চেয়েছিল। ভবনটির নীচে রিনা বেগম নামে এক নারী ছোট্ট চায়ের দোকান করে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি মাদকের স্পট পরিচালনা করেন।
ঘটনার বিষয়ে রিনা বেগম বলেন, ‘আমি সাড়ে ৫ বছর ধরে ভবনের নিচে চা বিক্রি করি। গতকাল অনেক ছেলেপেলে দৌড়াদৌড়ি করেছে। সেটি দেখলেও ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাইনা।’
পলাশকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে স্থানীয়রা জানান। রাত সাড়ে ৮টার দিকে আদাবর থানার এসআই ইব্রাহীম খলিলের নেতৃত্বে তিনজন পুলিশ আসে ঘনাস্থলে। তারা এসে পলাশকে উদ্ধার করে। তাকে নিয়ে সেই মেয়েটির বাসার সামনে আসেন। অপহরণের সঙ্গে জড়িত তিনজনকে আটকও করে পুলিশ। তাদের নিয়ে থানায় যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা পুলিশের গাড়িতে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেয়। চাপাতি ও সামুরাই দিয়ে গাড়িতে এলোপাতারি কোপাতে থাকে। এতে কনস্টেবল ও গাড়ি চালক আল আমিন গুরুতর আহত হন। পুলিশ দৌড়ে বিভিন্ন দিকে আশ্রয় নিতে থাকে। তবে গাড়িচালক আল-আমিন বের হতে পারেননি। তাকে তিন চারজন মিলে কোপাতে থাকে, এতে তার ডান হাতের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত লাগে। সব দোকানপাট মূহুর্তে বন্ধ হয়ে যায়। সবাই বাড়ির গেট বন্ধ করে দেয়। পুলিশ কনস্টেবল আল আমিন তখন বাঁচাও বাঁচও বলে চিৎকার করে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছিল। তিনি দৌড়ে শহীদুলের বাড়ির নীচ তলার লোকমানের ফার্মেসিতে আশ্রয় নেয়। সেখানেও ঢুকে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। ফার্মেসির সার্টার ভেঙে ফেলে।
প্রত্যক্ষদর্শী এক নারী বলেন, ‘পুলিশ ছিল মাত্র তিনজন, সন্ত্রাসীরা ছিল প্রায় ৫০-৬০ জন। তাদের সবার হাতে চাপাতি ছিল। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই কুপিয়েছে। পুলিশকে হামলা করে দ্রুত সন্ত্রাসীরা বেড়িবাধের দিকে চলে যায়।’
এরপর আহত পুলিশ সদস্যদের স্থানীয়রা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। বিষয়টি আদাবর থানা-পুলিশ জানার পর সেখানে যায় আদাবর থানার অন্য টহল পুলিশের গাড়ি, সেনাবাহিনী ও র্যাব। রাত ২টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ১০২ জনকে গ্রেপ্তার করে যৌথবাহিনী। আহত দুই কনস্টেবল রায়হান ও নাজমুল চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছাড়লেও জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে ভর্তি আল আমিন।
হামলার বিষয়ে এসআই ইব্রাহিম খলিল বলেন, হামলার নেতৃত্বে ছিল কিশোর গ্যাংয়ের মূল হোতা জনি ও রনি। তাদের সঙ্গে ছিলেন নাজির, ওসমান, দাঁতভাঙা সুজন, কবজিকাটা হৃদয় ও মাদক ব্যবসায়ী রাজুসহ আরও কয়েকজন। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তারা পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে জখম করে। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।
এই ঘটনায় ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ২৫ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন এসআই ইব্রাহিম খলিল। আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম জাকারিয়া মঙ্গলবার দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, গ্রেপ্তারকৃত সবাই স্থানীয় বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এ ঘটনায় থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। উৎস: আজকের পত্রিকা।