গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের তৃতীয় তলায় ডাকসুর প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন এক ব্রিফিংয়ে জানান, ডাকসু নির্বাচনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের শেষ দিনে বিভিন্ন পদে ৪৪২ জন প্রার্থী তা সংগ্রহ করেছেন। এ নিয়ে মোট মনোনয়নপত্র নিলেন ৫৬৫ জন। এ ছাড়া ১৮টি হল থেকে হল সংসদ নির্বাচনে মোট ১ হাজার ২২৬ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
নির্বাচনী হাওয়া বইছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে সরগরম হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। ডাকসু নির্বাচনে মনোয়নয়নপত্র সংগ্রহের শেষ দিন গতকাল সোমবার দলে দলে গিয়ে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ভোটে লড়তে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা। সূত্র: আজকের পত্রিকা
ভোটযুদ্ধে পাঁচটি প্যানেল
ডাকসু নির্বাচনে ২৮ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। গতকাল ঘোষিত এই প্যানেলে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বাইরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থী, আপ বাংলাদেশ এবং ইনকিলাব মঞ্চের শিক্ষার্থীদের রাখা হয়েছে। ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে সহসভাপতি (ভিপি) পদে আবু সাদিক কায়েম, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে এস এম ফরহাদ, সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে মহিউদ্দিন খানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতারা এককভাবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেও গতকাল রাত ১০টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্যানেল চূড়ান্ত করতে পারেনি সংগঠনটি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে রাতেই প্যানেল চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন ছাত্রদলের জসীমউদ্দীন হল শাখার আহ্বায়ক তানভীর বারী হামিম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেল এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আজ রাতে আমাদের প্যানেল চূড়ান্ত হবে। তবে আজ যেহেতু মনোনয়নপত্র নেওয়ার শেষ দিন, তাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে তা সংগ্রহ করেছি।’ জানা গেছে, ছাত্রদলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ভিপি পদে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন আবিদুল ইসলাম খান ও জিএস পদে তানভীর বারি হামীম।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ নামে প্যানেল দিয়ে ডাকসু নির্বাচনে লড়বে। তবে এই প্যানেল থেকে কে কোন পদে নির্বাচন করবেন, সেটি এখনো ঘোষণা করা হয়নি। গতকাল বিকেলে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব জাহিদ আহসান ডাকসু নির্বাচনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পর সাংবাদিকদের জানান, আজ মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা পরিচয় করিয়ে দেবেন। এ সময় জাহিদ আহসানের পাশে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, এই দুই নেতাই ভিপি ও জিএস পদে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের মনোনয়ন পাচ্ছেন।
এদিকে শেখ তাসনিম আফরোজকে (ইমি) সহসভাপতি (ভিপি) ও মেঘমল্লার বসুকে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী করে ডাকসু নির্বাচনে আংশিক প্যানেল ঘোষণা করেছে বাম গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট। তাসনিম আফরোজ সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে শামসুন নাহার হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর মেঘমল্লার বসু ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি। এই প্যানেল থেকে সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে প্রার্থী হচ্ছেন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল, আর মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক। বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর জাবির আহমেদ জুবেল জানান, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীসহ সাতটি সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাঁরা জোট গঠন করেছেন। বাকি পদগুলোতে প্রার্থীদের নাম আজ মঙ্গলবার ঘোষণা করা হবে।
অন্যদিকে ডাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্যানেল দিচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তিনি সহসভাপতি (ভিপি) পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। একই প্যানেলে সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি আল সাদী ভূইয়া এবং সহসাধারণ সম্পাদক পদে বর্তমান সভাপতি মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহী। উমামা ফাতেমা বলেছেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীবান্ধব একটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করব।’
ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালে। ২৮ বছরের অচলায়তন ভেঙে সেই বছরের ১১ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০২০ সালে এর মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে গত পাঁচ বছরে কোনো নির্বাচন দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আওয়ামী সরকারের পতন এবং শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে অবশেষে গত ২৯ জুলাই ডাকসু নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে।
পাঁচ বছর পরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই নির্বাচন ঘিরে সংগঠনগুলোর পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও উচ্ছ্বাস বাড়ছে। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসন ও সংগঠনগুলোর আন্তরিকতার ওপর ডাকসুর কার্যকারিতা নির্ভর করছে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও মতবিনিময় থেকে বোঝা যাচ্ছে, সবাই একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ চান। এবার ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।’
ইংরেজি বিভাগের আব্দুল্লাহ আল শাহিদ বলেন, ‘প্রথমত ডাকসু নির্বাচন যাতে স্বচ্ছ হয়, এটা আমাদের প্রত্যাশা। ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে যাতে না হয়, সেটা আমাদের প্রত্যাশা। দ্বিতীয়ত আমার প্রত্যাশা ডাকসু যাতে নিয়মিত আয়োজন করা হয়।’
এদিকে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর আবু মুজাহিদ আকাশ বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডাকসু আয়োজনের ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। কিছু অসন্তোষ থাকলেও আমরা অংশ নিচ্ছি। আশা করি এবারের ডাকসু হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ।’
ছাত্রদলের স্যার এ এফ রহমান হল কমিটির সদস্যসচিব মাহাদিজ্জামান জ্যোতি বলেন, ‘আমরা চাই সঠিক সময়ে ডাকসু নির্বাচন হোক। তবে হলে এখনো ফ্যাসিস্ট দোসরদের অবস্থান প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কার্যকরী নির্বাচন কতটা সম্ভব, সেটি নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।’
বাধার অভিযোগ ছাত্রদলের
ফজিলাতুন নেছা মুজিব হল সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় মব সৃষ্টি করে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ছাত্রদল। গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করে সংগঠনটি।
ছাত্রদলের ঢাবি শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সংগঠনের নির্দেশনা অনুযায়ী দিনব্যাপী বিভিন্ন হল ও ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। কিন্তু ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে গেলে কিছু শিক্ষার্থী প্রশাসনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন এবং ছাত্রদল-সমর্থিত প্রার্থীদের ওপর হামলার চেষ্টা চালান।
ছাত্রদল সভাপতি আরও বলেন, ‘ঢাবির শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের প্রাণের দাবি ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন। সার্বিক পরিবেশ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ঘাটতি থাকলেও শিক্ষার্থীদের অনুভূতি ও গণতান্ত্রিক চর্চাকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’