বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সূত্র জানায়, দেশের আকাশপথে বাণিজ্য কার্যক্রম প্রায় পুরোপুরি ঢাকাকেন্দ্রিক। অতীতে কিছু পণ্য সড়কপথে ভারতে নিয়ে গিয়ে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে রফতানি হতো। তবে হঠাৎ করেই ভারত এ সুবিধা বাতিল করায় রফতানিকারকরা এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন। কিন্তু সংকটের মাঝেই নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। সূত্র: ইত্তেফাক
বাংলাদেশের আকাশপথে আমদানি ও রফতানির মূল কেন্দ্রবিন্দু ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রতিবছর এ বন্দর দিয়েই গড়ে ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন রফতানি এবং ১ লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টন আমদানি পণ্য পরিবাহিত হয়। এর বিপরীতে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রফতানি হয় মাত্র ৩ হাজার ৩৫২ মেট্রিক টন এবং আমদানি ২ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র রওশন কবীর জানান, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ হয়ে গেলেও আকাশপথে রফতানি বন্ধ হয়নি, বরং উল্টো তা দেশের নিজস্ব সক্ষমতা নির্মাণের একটি মোড় বদল সময় হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়ায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), রফতানিকারক এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস যৌথভাবে এগিয়ে আসে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ফ্রেইটার অপারেশনের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। গত মার্চে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের প্রাপ্য আরএ-৩ সার্টিফিকেশন নিশ্চিত করা হয়, যা ২০২৮ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এর ফলে গত ২৭ এপ্রিল স্পেনের জারাগোজা শহরে সিলেট থেকে প্রথম এয়ার ফ্রেইটার ফ্লাইট আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। মে মাসজুড়ে সপ্তাহে একটি করে ডেডিকেটেড ফ্রেইটার পরিচালিত হয়েছে; জুন থেকে এই সংখ্যা বাড়িয়ে সপ্তাহে দুটি করা হবে। বিমানের পরিকল্পনায় আছে প্রতি সপ্তাহে অন্তত চারটি ফ্রেইটার চালানোর প্রস্তুতি।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকেও শিগগিরই ফ্রেইটার অপারেশন চালুর প্রস্তুতি চলছে। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ সেখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলছে। একই সঙ্গে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে নতুন সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। সম্প্রসারিত রানওয়ে, সুদৃঢ় অবকাঠামো এবং ঢাকা-কক্সবাজার রেল যোগাযোগ চালু হওয়ায় স্বল্প খরচে ও সময়সাপেক্ষে পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কক্সবাজারে কার্গো ওয়্যারহাউজ, হ্যান্ডলিং সরঞ্জাম ও জনবল তৈরিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অন্যদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কাজ শেষ পর্যায়ে। এই টার্মিনাল চালু হলে কার্গো পরিচালনার সক্ষমতা প্রায় তিনগুণ বাড়বে। বর্তমানে যেখানে বছরে গড়ে ৩ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন কার্গো পরিবহন হয়, ২০২৫ সালের মধ্যে তা ৪ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হবে। ২০৩৫ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ৬ লাখ ৬৩ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, নতুন টার্মিনালের জন্য ইতোমধ্যে ৩৩৫টি হাইড্রোলিক হ্যান্ড ট্রলি, ৮টি টো ট্রাক্টর, ১৮টি মিনি ফর্ক লিফট, ১৪টি ফর্ক লিফট এবং ৬টি বাগিসহ মোট ৩৮১টি আধুনিক সরঞ্জাম সংযোজনের কাজ চলছে, যার বড় অংশ ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কার্গো বিভাগ রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব অর্জন করেছে। কার্গো নিরাপত্তা ও গুণগত মানের প্রতীক হিসেবে আরএ-৩ এবং এসিসি-৩ সার্টিফিকেশন অর্জন করেছে বিমান, যা ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের বাজারে কার্গো প্রবেশে অপরিহার্য। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ৪৮টি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনের নির্ধারিত কার্গো হ্যান্ডলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি প্রতি বছর গড়ে ২ হাজার ১০০টি নন-শিডিউল চার্টার কার্গো ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে অপারেশনাল সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে।
এছাড়া ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিমান ইতিহাদ, এমিরেটস, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, গালফ এয়ার, কেএলএম, এয়ার ফ্রান্সসহ বিভিন্ন এয়ারলাইনের সঙ্গে বিশেষ প্রোরেট অ্যাগ্রিমেন্ট (এসপিএ), ব্লক স্পেস অ্যাগ্রিমেন্ট (বিএসএ), কোড-শেয়ারিং এবং কৌশলগত অংশীদারত্ব স্থাপন করতে কাজ করছে। এর মাধ্যমে কার্গো নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র এ. বি. এম. রওশন কবীর বলেন, সংকটকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করার যে সাহস, নেতৃত্ব ও দক্ষতা প্রয়োজন- তা প্রমাণ করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। আজ আকাশপথে কার্গো কেবল পণ্য নয়, এটি দেশের স্বপ্ন, গর্ব ও বিশ্বজয়ের প্রতীক। আর সেই প্রতীকে নতুন ডানা যোগ করছে বিমান।