ফয়সাল চৌধুরী, কুষ্টিয়া: [২] কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত শিমুলিয়া গ্রাম। ২০১৯ সালের পর এরই নাম হয়ে গেছে ইউটিউব ভিলেজ। ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয় করা অর্থ দিয়ে এই গ্রামের সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামের সৌন্দর্যবর্ধন এবং বিনোদনের জন্য তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ইউটিউব পার্ক। এই পার্কের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে বাঁশ-কাঠ আর খড়ের অবকাঠামো এবং ছায়া-সুনিবিড় পরিবেশ ভ্রমণপ্রিয় মানুষের মন ভুলিয়ে দেবে। এই গ্রামের দু’জন যুবকের নেতৃত্বে শুধু মাত্র ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে স্বাবলম্বী হয়েছে অনেকে। সেই সঙ্গে তারা সবসময়ই পাশে দাঁড়াচ্ছেন এলাকার প্রতিবন্ধী এবং অসহায় মানুষের পাশে। প্রথম দিকে শখের বসে এটি শুরু করলেও এখন তা অনেকের আইকনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
[৩] জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ইউটিউবে লিটন আলী নামের স্থানীয় এক যুবক শখের বশে অ্যারাউন্ড মি বিডি নামে একটি চ্যানেল খোলেন। স্থানীয়ভাবে ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবার রান্না করে গ্রামের সাধারণ মানুষকে খাওয়াতে থাকেন তাঁরা। রান্না থেকে খাওয়ানো পর্যন্ত সময় ভিডিও ধারণ করে ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করতে শুরু করেন তাঁরা। এই কাজে এলাকাবাসীর ব্যাপক উৎসাহ এবং ইউটিউবে দর্শকসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি নিয়মিতভাবে এই কাজ শুরু করেন। একসময় বিদেশি রান্নাবিষয়ক জনপ্রিয় অনেক ফেসবুক পেজে শেয়ার হয় ভিডিওগুলো। সেই ভিডিও চোখে পড়ে বেস্ট এভার ফুড রিভিউ শো চ্যানেলের সানি সাইড এর। তিনি নিজের চোখে এই কার্মকাণ্ড দেখার জন্য ছুটে আসেন এই গ্রামে। তারপরে থেকেই এই গ্রামটি ইউটিউব গ্রাম নামে পরিচিতি পায়। এখন গ্রামটিতে বেড়াতে আসেন দেশ-বিদেশের অনেক দর্শনার্থী। আর এসব দর্শনার্থীর বিনোদনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এই গ্রামের বিশাল এলাকাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে ইউটিউব পার্ক। পার্ক নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থও খরচ করা হচ্ছে ইউটিউব চ্যানেলের আয় থেকে।
[৪] লিটনের বাড়ি কুষ্টিয়া উপজেলার উত্তর শ্যামপুর গ্রামে। শিমুলিয়া গ্রামে মূলত তার নানার বাড়ি। কিন্তু তিনি এলাকার ভোটার। ২০১২ সালে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে যৌথ মালিকানায় ইকরাসিস সলুশনস লিমিটেড নামের একটি সফট্যাওয়ার ফার্ম পরিচালনা করছেন তিনি। সেই কাজের সুবিধার্থে বেশিরভাগ সময় ঢাকাতে অবস্থান করেন। বর্তমানে শিমুলিয়া গ্রামে ইউটিউবের জন্য বিভিন্ন ভিডিও বানানোর কাজ পরিচালনা করেন তার মামা দেলোয়ার হোসেন।
[৫] গ্রামের নাম পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেন, "২০১৯ সালে বেস্ট এভার ফুড রিভিও শো নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সত্ত্বাধিকারী সানি আমেরিকা থেকে আমাদের গ্রামে আসেন। তার আগমন উপলক্ষ্যে আমরা যে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলাম, সেখানে রান্নার কাজে গ্রামের প্রায় সকল মানুষ স্বতস্ফুর্তভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তখন সানি মন্তব্য করেছিলেন, 'আপনাদের কাজের সঙ্গে গ্রামের পুরো মানুষ জড়িত। তাই এটাকে ইউটিউব ভিলেজ বলা যায়।' তখন থেকেই লোকের মুখে মুখে গ্রামটি ইউটিউব ভিলেজ নামে পরিচিত লাভ করে।"
[৬] লিটন বলেন, প্রথমত কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়া শুরু করলেও এখন সব কিছুই গুছিয়ে করা হয়। আরও ৫টি চ্যানেল চালু করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন পার্ক তৈরি করা হয়েছে। পার্ক থেকেও কিছু আয় হয়। এখন যা করা করা হচ্ছে তা মূলত চ্যানেলের আয় থেকে। এ আয় থেকেই রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা, ৫জন ভিডিওগ্রাফার, রাঁধুনিসহ প্রায় ১১০ জন মানুষের বেতন ও সম্মানীর ব্যবস্থা হয়ে যায়। এর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।
[৭] গ্রামে গিয়ে দেখা যায় লিটন আলীর মামা দেলোয়ারের ব্যাক্তিগত ৩৫ বিঘা জমিতে পুরোদমে চলছে পার্ক উন্নয়নের কাজ। পার্কের ঢোকার পথেই চোখে পড়ে দৃষ্টিনন্দন গেট। ভিতরে ঢোকার পথে চোখে পড়ে বাঁশ, খড়, বাতা দিয়ে তৈরি গ্রামীণ ঐতিহ্যের বাহন গরুর গাড়ি, রিকশা এবং লেকের মাঝে তৈরি ভাসমান ঘর। এ ছাড়া নারকেল আকৃতির ঘর, ভালোবাসার প্রতীক হৃদয় আকৃতির বসার জায়গা, বাঁশ ও খড় দিয়ে ব্যাঙের দৃষ্টিনন্দন ছাতা, ছোট ব্রিজ, দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য পুকুরের মাঝে গোলঘরসহ শিশুদের জন্য বিভিন্ন রাইড দর্শনার্থীদের সময়কে রাঙিয়ে তুলবে। লেকের ওপর নির্মিত কাঠের কারুকাজ করা ছোট্ট সেতু যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি সেতু পার হয়ে বন্য পরিবেশের আদলে তৈরি কৃত্রিম ঝরনা আগতদের শরীর, মন-দুটোই ভিজিয়ে দেবে।
[৮] গ্রামের উন্নয়নের জন্য ও নিয়মিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন লিটন আলী এবং দেলওয়ার। শিমুলিয়া গ্রামের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যাক্তি শাহিন আলী মন্ডল। তার থাকার জন্য কোনো ঘর ছিল না, বিষয়টি নজরে আসার পরে দেলওয়ার হোসেন শাহিন আলীকে একটি দুই কক্ষ বিশিষ্ট টিনের ঘর করে দেন।
[৯] শাহীন আলীর পিতা সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে হাতে পায়ে শক্তি পায় না। তাই কোনো কাজ করতে পারে না। ছেলের থাকার জন্য আলাদা কোনো ঘরও ছিল না। বিষয়টি জানার পর দেলোয়ার মাস্টার তাকে একটি ঘর তুলে দিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া আমি দেলওয়ার মাস্টারের পার্কে কাজ করি। সেখান থেকে যা আয় হয় আমাদের সংসার চলে যায়।
[১০] ইউটিউব চ্যানেলসহ পার্ক এবং সকল কর্মকাণ্ড বর্তমানে পরিচালনা করেন দেলওয়ার হোসেন। তিনি জানান, ইউটিউবের জন্য প্রথমে গ্রামের ৭ বেকার যুবক বাঁশের বিভিন্ন ব্যবহার নিয়ে ভিডিও আপলোড করার মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থান হয়। আমাদের রান্নার কাজ দেখতে অনেক দূর থেকে লোকজন এখানে আসে। এবং এখানে বিনোদনের ব্যবস্থা থাকায় আরও বেশি দর্শনার্থী বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ আমাদের এখানে আসে।
[১১] তিনি বলেন, ইউটিউব থেকে এখন ভালোই উপার্জন হয়। সেখান থেকে প্রতি মাসে ৫০ জনকে এবং পার্কে কর্মরত ৬০ জনসহ মোট ১১০ জনকে সম্মানী দেওয়া হয়। এখন আমরা গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করতে পারছি। পাশাপাশি অসহায় মানুষের মুখে সামান্য খাবার তুলে দিতে পারছি, বেকারকে চাকরি দিতে পারছি। এতে করে একদিকে যেমন বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হয়েছে, এর চাইতে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না। ভবিষ্যতে এখানে একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করে এলাকাবাসীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে বলেও জানান দেলোয়ার হোসেন।
[১২] যদিও সরকারিভাবে গ্রামটি এখনো লিমুলিয়া হিসেবে পরিচিত। তবে কুষ্টিয়া জেলাতে ইউটিউব ভিলেজ নামে বেশি পরিচিত।
[১৩] শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস বলেন, "লিটনের হাত ধরে শুরু হলেও এখন গ্রামে তরুণ ও যুবকদের মাধ্যমে হাজারের বেশি চ্যানেল পরিচালিত হচ্ছে। এতে অনেকে মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। নারীরা তাদের কাজে সহায়তা করে বাড়তি আয় করতে পারছেন। ইউটিউবারদের উপর্জিত অর্থে গ্রামের বিভিন্ন উন্নয়নও হচ্ছে।"
প্রতিনিধি/এইচএ