শিরোনাম
◈ বিশ্বসেরা মেধাবীদের জন্য ভিসা ফি বাতিল করতে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য ◈ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সতর্কবার্তা ◈ নিজ দেশেই বোমা হামলা পাকিস্তান বিমানবাহিনীর, নারী-শিশুসহ নিহত ৩০ ◈ ছাত্রদলের দাবির মুখে পেছালো রাকসু নির্বাচন ◈ বিএনপির উদার দৃষ্টিভঙ্গি স্থিতিশীল বাংলাদেশের অর্জনে সহায়ক হবে, মঈন খানের বাসভবনে ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ◈ আমাকে দোষী বানাতে ‘ভুয়া’ নথি ব্যবহার হচ্ছে: দাবি টিউলিপের ◈ আন্দোলনে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া অডিওতে হাসিনার কণ্ঠ শনাক্ত: ট্রাইব্যুনালে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ◈ ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ছে: চলতি বছরে ১৭৯ জন নিহত, হাসপাতালে আসার মাত্র দু-তিন দিনের মধ্যে প্রাণহানি বেশি ◈ বিশেষ রাজনৈতিক দলের লোকজনকে ডিসি-এসপি বানানো হচ্ছে: রুহুল কবির রিজভী ◈ যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়ার পর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিচ্ছে ফ্রান্স

প্রকাশিত : ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৭:২৬ বিকাল
আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১০:৪২ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সুন্দরবনে বনদস্যুদের দৌরাত্ম্য: আতঙ্কিত জেলেরা

এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধি: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাতবিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের উপকূলে সুন্দরবনে মারাত্মক আতঙ্কে বনজীবীরা, দফায় দফায় টাকা দিয়েও পাচ্ছে না ‌রেহাই ‌, অবশেষে বনজীবীরা বর্তমানে দিশেহারা হয়ে ভিন্ন পেশায় ফিরে যাবার চিন্তা করছে হাজারো বনজীবীরা‌। বর্তমানে সুন্দরবনে সাতটি জলদস্য বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লোকালয়ে থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত।

বনজীবীরা কয় দল জলদস্যদের টাকা দিয়ে পারবে দফায় দফায় টাকা দিয়ে এখন বনজীবীরা সুন্দরবনে যেতে অনীহা প্রকাশ করছে ‌। বনবিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন ‌সংরক্ষক ইমরান আহমেদ জানান গত বছর এই মাসের তুলনায় এ বছর এই মাসে সরকারি রাজস্ব কমে গেছে তুলনামূলকভাবে তার একমাত্র কারণ বনদস্যদের দাপটে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বনজীবীরা সে কারণে সরকারি রাজস্ব তুলনামূলকভাবে সংকট দেখা দিয়েছে ‌।‌‌সরকারিভাবে দস্যুমুক্ত ঘোষিত সুন্দরবনে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বনদস্যুরা। এরই মধ্যে চাঁদার দাবিতে কয়েক দফায় বনজীবীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। বনদস্যুরা গত এক মাসে অপহরণ করে অর্ধশতাধিক জেলেকে। মুক্তিপণ দিয়ে কিছু জেলে ছাড়া পেলেও এখনো অনেক জেলে জিম্মি রয়েছে দস্যুদের কাছে। এমন পরিস্থিতিতে পেশা বদলাচ্ছেন বনজীবীরা। ফলে বনবিভাগের রাজস্ব আদায় কমেছে অর্ধেকের নিচে।

এক সময় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ছিল অপহরণ, ডাকাতিসহ নানা অপরাধের অভয়ারণ্য। তখন প্রায় বনদস্যু বাহিনীগুলোর কাছে জিম্মি হতে হতো জেলেদের। চাহিদামতো চাঁদা দিলে মিলতো মুক্তি, আর নয়তো মৃত্যু। জিম্মি বনদস্যুদের উদ্ধারে তখন প্রায়ই গহীন বনে অভিযান চালাতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই সময় অনেক দস্যুর মৃত্যুও হয়েছে ক্রসফায়ারে, আর আহত হয়েছে অনেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। একপর্যায়ে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি বাহিনীর প্রধানসহ ৩২৪ দস্যু তাদের কাছে থাকা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল। এরপর ২০১৮ সালে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করে সরকার; কিন্তু দস্যুমুক্ত বলা সেই সুন্দরবনে এখন প্রায়ই ঘটছে জেলেদের ওপর হামলার ঘটনা।

গত ২৭ জানুয়ারি কমান্ডো স্টাইলে সুন্দরবনের দুবলারচর সংলগ্ন এলাকায় জেলেদের ওপর হামলা চালায় বনদস্যু দয়াল বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় জেলেদের জিম্মি করার চেষ্টা করলে তারা একত্রিত হয়ে অস্ত্রসহ ৩ বনদস্যুকে ধরে কোস্টগার্ড সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করে। এর আগে বিছিন্নভাবে দুই-একজন করে জেলেকে জিম্মি করলেও এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে পরের দির ১৫ জেলেকে জিম্মি করেছে ওই দস্যুরা।

অপহরণের ১৭ দিন পর মাথা পিছু ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৯ জেলে। মুক্তিপণ নিয়ে জেলেদের চোখ বেঁধে ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ এলাকায় জঙ্গল থেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে যায় বনদস্যুরা। বৃহস্পতিবার ভোর রাত ৩টায় তারা নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছায়। মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাওয়া জেলে শাহীনুর আলম জানান, জিম্মি করে বনদস্যুরা তাদের অনেক মারধর করেছে। এমন অবস্থায় তারা আর সুন্দরবন যাবেন না বলে জানান।

মোংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের বাসিন্দা জেলে অমৃত বৈরাগী বলেন, দস্যুমুক্ত হওয়ার পর এক সময় অনেক জেলে সুন্দরবন যেত নির্ভয়ে; কিন্তু এখন নতুন করে দস্যুতা শুরু হওয়ায় তারা পেশা পরিবর্তন করে অন্য কাজ শুরু করে দিয়েছেন। অনেক জেলে এখন দিনমজুরের কাজ করছেন।

দস্যুদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তারেক আহম্মেদ জানান, তারা নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। কিছু অপরাধীকে আটক করতে সক্ষম হয়েছেন। এদিকে পর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা মিল্টন রায় জানান, সুন্দরবনে দস্যুতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে জেলেরা আমাদের জানিয়েছেন। তাই এখন বনজীবীরা সুন্দরবনে যাচ্ছে না। রাজস্ব আদায় নেমেছে অর্ধেকের নিচে। তিনি জানান, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ দিনে চাঁদপাই স্টেশন থেকে ৪৭৮টি পাস পারমিট দেওয়া হয়েছিল বনজীবীদের। আর ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ দিনে সেখানে পারমিট দেওয়া হয় ২৩৬ টি। এদিকে ‌মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করে আদায় করছে মোট অঙ্কের টাকা। বিকাশের মাধ্যমে দাবিকৃত টাকা পরিশোধ করার পর মুক্তি মিলছে অপহৃতদের। ফলে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে জীবিকার টানে সুন্দরবনে ঢোকা জেলেদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জনৈক অয়েজকুরুনি গাজীর জেলে হিসেবে গত মঙ্গলবার শ্যামনগর উপজেলার টেংরাখালী গ্রামের নুর হোসেনের ছেলে আব্দুস সালাম (২৫) ও ভেটখালী নুতনঘেরি গ্রামের কৃষ্ণ কাহারের ছেলে বিজয় কাহার (৩৮) মাছ ধরতে সুন্দরবনে যায়। দু’দিন পর বৃহস্পতিবার বিকালে পায়রাটুনি খালে জাল বিছানোর সময় পাঁচ সদস্যের জলদস্যুর একটি দল সেখান থেকে বিজয় কাহার ও আব্দুস সালামকে অপহরণ করে। জলদুস্যুরা তাদের মুক্তির জন্য মাথাপিছু মুক্তিপণ হিসেবে ৫০ হাজার করে টাকা দাবি করে।

এঘটনার পর ৫ সেপ্টেম্বর রাতে বিকাশের মাধ্যমে মুক্তিপণের ৩৬ হাজার টাকা পরিশোধের পর জলদস্যুরা ৬ সেপ্টেম্বর ভোরে আব্দুস সালামকে মুক্তি দেয়। ঐদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সুন্দরবন ফেরত অপর জেলেদের নৌকাযোগে তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন।

ফিরে আসা জেলে আব্দুস সালামের পিতা নুর হোসেন জানান, একদিন পরে জিম্মি জেলেদের পরিবারের কাছে কাছে মোবাইলে যোগাযোগ করে মুক্তিপণ বাবদ মাথাপিছু ৫০ হাজার করে টাকা দাবি করা হয়। পরবর্তীতে অনুনয়বিনয় করে ছেলের মুক্তিপণ বাবদ ৩৫ হাজার টাকায় জলদস্যুদের রাজি করাতে সম্মত হন। পরে টাকা পরিশোধের পর তাকে ছেড়ে দেয় দস্যুরা। জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা অপর জেলে বিজয় কাহারের পিতা কৃষ্ণ কাহার জানান, শনিবার পর্যন্ত তিনি মুক্তিপণের টাকা সংগ্রহ করতে পারেননি। ছেলের মুক্তিপণ বাবদ জলদস্যুদের দাবিকৃত ৫০ হাজার টাকা ০১৯১৬৮১৩৬৪৯ নম্বরে বিকাশ করতে বলেছেন তারা।
ফিরে আসা জেলে আব্দুস সালাম জানায়, পাঁচ সদস্যের জলদস্যু দলটির কাছে তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। তারা ছোট একটি ডিঙি নৌকা নিয়ে সুন্দরবনের মধ্যে দস্যুতা করছে।

এদিকে এর আগে গত ২৫ আগস্ট ও ২৬ আগস্ট দুই দফায় সুন্দরবনের দাড়গাং নদী সংলগ্ন খাল থেকে চারজন ও হোগল ডোকরা খাল এবং কালির খাল থেকে তিনজনসহ মোট ৭ জেলেকে অপহরণ করে জলদস্যুরা। এরা হলেন, শ্যামনগরের পার্শেখালি এলাকার ইব্রাহীম সর্দার, আব্দুল হাকিম, সুজিত মুন্ডা, কালিঞ্চি এলাকার সাত্তার গজী, আকিনুর, কৈখালীর বুলবুল গাজি ও রমজাননগরে তারানীপুর গ্রামের আরাফাত হোসেন। পরে মুক্তিপণ দিয়ে তারা সবাই ফিরে আসে।

জলদস্যুদের দাবিকৃত মুক্তিপণের ৬০ হাজার টাকা দিয়ে ফিরে আসা জেলে সুজন মুন্ডা জানান, সুন্দরবনে মুন্না বাহিনী নামে নতুন একটি বনদস্যু বাহিনী এসব জেলেদের অপহরণ করেছে।

প্রথম চালান মাছ ধরে লোকালয়ে ফিরে আসা জেলে আবুল হোসেন জানান, তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে এক তারিখে আমরা সুন্দরবনে ঢুকেছিলাম। কিন্তু জলদস্যুদের অপতৎপরতার কারণে বেশিদিন থাকতে পারলাম না। সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরার সময় সবসময় ভয় ভয়ে থাকতে হয়। তিনি সুন্দরবনে জলদস্যুদের অপতৎপরতা রোধে বন বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এ বিষয়ে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মোঃ ফজলুল হক জানান, সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এলাকাসহ যেসব এলাকায় জেলেরা মাছ ধরে সে সমস্ত এলাকায় বন বিভাগ ও স্মার্ট পেট্রোল টিমের পক্ষ থেকে টহল জোরদার করা হয়েছে। জেলেদেরকে নজরে রাখার জন্য টিমের সদস্যদেরকে বলা হয়েছে।

এরপরও কোন জেলে অপহরণের শিকার হলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে কিছুই জানানো হয় না। নিরাপত্তার স্বার্থে তারা আমাদের কাছে গোপন রাখে। সঠিক তথ্য পেলে বনবিভাগ, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা অভিযান পরিচালনা করতে পারে বলে জানা নেই বন কর্মকর্তা।

শ্যামনগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির মোল্লা জানান, কোন জেলে অপহরণ হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা আমাদেরকে কিছুই জানায় না। অপহৃত জেলেদের বিপদ হতে পারে এই ভেবে তাদের অভিভাবকরা টাকা দিয়ে তাদেরকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করে। এরপরে অভিযোগ পেলে পুলিশ অপহৃতদের উদ্ধারের পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
তিনি আরো বলেন, “সুন্দরবনে জেলেদের অপহরণের বিষয়টি আমরা তৃতীয় ও চতুর্থ পক্ষের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে কাজ করে থাকি। আশা করছি দ্রুত একটা ফলাফল পাওয়া যাবে।*

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়