এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট: খুলনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চোখ হারানো ‘জুলাইযোদ্ধা’ আব্দুল্লাহ আল শাফিল বলেন, “শেখ হাসিনা চলে গেছে শুনে ওই মুহূর্তে মনে হয়েছিল আমার অন্ধত্ব কামিয়াব হয়েছে। আমি যেটা হারিয়েছি সেটা দিয়ে আমি না হলেও অন্যরা অন্তত সারা দেশটাকে দেখতে পারবে।”
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার শাফিল খুলনার বেসরকারি নর্দান ইউনিভার্সিটি বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ২ আগস্ট খুলনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি চোখে আঘাত পান এবং দৃষ্টিশক্তি হারান।
শাফিল জানান, তিনি যখন জানতে পারেন শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছেন, তখন তার চোখের ব্যথা মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “তখন মনে হচ্ছিল, এটি হয়তো জাতির জন্য বিশাল কোনো ষড়যন্ত্র, অথবা বিশাল মুক্তির সংবাদ। আমার চোখে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার সেই সেন্স কাজ করছিল না।”
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট: খুলনার রাজপথে নতুন স্বাধীনতার উল্লাস
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দিনটি ছিল সোমবার। ওইদিন সকালে খুলনা মহানগরীর শিববাড়ি মোড়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা জড়ো হয়। বিকেল আড়াইটার দিকে যখন শিক্ষার্থীরা জানতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছেন, তখন পুরো খুলনা নগরী বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ জাতীয় পতাকা হাতে সড়কে নেমে আসে। মা-বাবার সঙ্গে শিশুরা এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়।
অনেকেই তখন বলেন, “আমরা ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু আজ ২০২৪ দেখলাম। এটা এক নতুন স্বাধীনতা, নতুন বাংলাদেশ।”
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়োল্লাসের সঙ্গে তুলনা করে অনেকেই বলেন, মানুষের মধ্যে তেমনই আনন্দ বিরাজ করছিল। শহরের প্রতিটি প্রান্তে বিতরণ করা হয় মিষ্টি।
আন্দোলনের নেতাদের চোখে ৫ আগস্ট
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা মহানগরের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নাঈম মল্লিক বলেন, “৪ আগস্টের মধ্যেই খুলনায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা বিতাড়িত হয়। ৫ আগস্ট আমরা যখন শিববাড়ি মোড়ে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছিলাম, তখন হঠাৎ খবর আসে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এরপর আমরা হাদিস পার্কে বিজয় মিছিল করি। ওই দিন আমরা টিম ভাগ করে খুলনাবাসীর নিরাপত্তার জন্য টহল দিয়েছি।”
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে মানুষ নাচ-গান করেছে, মিষ্টি বিতরণ করেছে। এই মিশ্রিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল ওই দিনের উল্লাস। সবাই মনে করেছিল ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে মুক্তি মিলেছে। এটি ছিল নতুন স্বাধীনতার স্বাদ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি বলেন, “৫ আগস্ট সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত ছিল যখন দেখলাম ছোট ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে মহিলারা রাজপথে নেমে এসেছে। তাদের দেখে ঈদের থেকেও বেশি খুশি মনে হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “জুলাই আন্দোলনে আমাদের ২ হাজার মানুষ জীবন দিয়েছে, শত শত শিশু শহীদ হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ চোখ হারিয়েছে এবং ৩০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেছে। আমাদের একটাই চাওয়া, এই ত্যাগ যেন বৃথা না যায়। নতুন বাংলাদেশে যেন আর কোনো ফ্যাসিবাদের জন্ম না হয়।”