শাহজাদা এমরান,কুমিল্লা : মো. রাসেল। বয়স ৩০ থেকে ৩২ হবে। দুই পা ও এক হাত নেই। কিন্তু তাই বলে অসহায়ের মতো মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করতে নারাজ সে। তার সোজা বক্তব্য, আল্লাহ তো আমার একটি হাত রেখেছেন। এটা দিয়েই আমি কর্ম করে খাচ্ছি। প্রতি বছর কোরবানির ঈদ আসলে মৌসুমি ব্যবসায়ীর তকমা লাগিয়ে গো-খাদ্য ও গরু জবাইয়ের উপকরণ বিক্রি করেন কয়েক দিন। এরপর সারা বছর অটো চালিয়ে সংসারের খরচ নির্বাহ করেন এই অদম্য রাসেল।
বলছিলাম রাসেলের কথা। পিতা আবুল কাসেম। কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার দক্ষিণ দুর্গাপুর ইউনিয়নের সাতোরা চম্পকনগর তাদের বাসা। পিতা-মাতার চার ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে রাসেলের অবস্থান দ্বিতীয়। সমাজের অন্য দশটা সুস্থ মানুষের মতোই ধরণীতে রাসেলের আগমন। দরিদ্র পিতার ঘরে জন্ম নেওয়া রাসেলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গÐি অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। তাই বুঝ হওয়ার পর থেকেই বাবার সাথে দিনমজুরের কাজ করা শুরু করেন। এভাবেই চলছিল তার জীবন। রাসেল স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, কষ্ট করে কাজ করে একটি ভালো ব্যবসা করবেন। কিন্তু তার জীবনের স্বপ্ন পাল্টে যায় একটি রেল দুর্ঘটনায়।
২০০৬ সালের স্নিগ্ধ সকাল। সজীব গাছের পাতাগুলো থেকে তখনো ভোরের শিশির হয়তো ঝরে পড়েনি। কিন্তু এরই মধ্যে ঝরে গেছে দরিদ্র রাসেলের দুই পা ও এক হাত। সারা জীবনের জন্য হয়ে গেলেন পঙ্গু। যদিও তখন কেউ ভাবেননি যে সে বাঁচবে। কিন্তু মহান আল্লাহ তাকে নতুন জীবন দান করলেও কেড়ে নিয়েছেন পা ও হাত। সেদিন ভোরে কুমিল্লায় আসার জন্য লাকসাম থেকে ট্রেনে উঠেন। ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে যান রাসেল। ট্রেনটি যখন কুমিল্লা স্টেশনে এসে যাত্রাবিরতি শেষ করে ছেড়ে দেয়, তখনই ঘুম ভেঙে যায় রাসেলের। তিনি দেখেন ধীরলয়ে কুমিল্লা স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছে ট্রেন। যদিও ট্রেনের তখন বেশি গতি ছিল না কিন্তু চলন্ত ছিল। তাই হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে পা পিছলে রাসেল পড়ে যান ট্রেনের চাকার নিচে।
সাথে সাথে রাসেলের দেহ থেকে দুই পা ও বাম হাত সারা জীবনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন কেউ ভাবেনি রাসেল বাঁচবে। যাই হোক, রাসেলের দরিদ্র পিতা জীবনের সর্বস্ব দিয়ে সন্তানকে আল্লাহর রহমতে বাঁচাতে পারলেও জোড়া লাগাতে পারেননি দুই পা ও এক হাত। তাই শুরু হলো রাসেলের জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস।
পঙ্গু রাসেলকে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিল ভিক্ষা করতে। কিন্তু ভিক্ষাকে ঘৃণার চোখে দেখেন রাসেল। তার সোজা কথা, আল্লাহ তো আমার একটি হাত রেখেছেন। অনেকের তো একটি হাতও নেই। আমি তো তার চেয়ে ভালো আছি। সুতরাং আমি কর্ম করে খাব। যেই কথা সেই কাজ। রাসেল অটোরিকশা চালানো শিখে নিলেন। সিটে বসে এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালান। তার নিয়মিত রোড হচ্ছে, কান্দিরপাড় থেকে সাতোরা চম্পকনগর এবং ঝাগুরঝুলি বিশ্বরোড।
ইতিমধ্যে রাসেল বিয়ে করেছেন। এক ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা তিনি। তার স্বপ্ন, তার সন্তানরা যেন তার মতো অটোচালক না হয়। ফলে কষ্ট করে সংসার চালিয়ে টাকাও কিছু কিছু জমাতে চেষ্টা করেন সন্তানদের পড়াশোনা করাতে। বড় ছেলে এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
রাসেল জানান, একটু বেশি আয়ের আশায় গত চার বছর ধরে কোরবানি ঈদের আগের চার দিন অটোচালানো ছেড়ে দিয়ে মৌসুমি ব্যবসা করেন। তিনি গরু জবাইয়ের সময় ব্যবহৃত হোগলা, মাংস কাটার ঘঁইট্টা, ধানের খড়, ভূসি, ঘাস ইত্যাদি বিক্রি করেন। এবার ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা ঋণ করে মাল কিনেছেন বলে জানান রাসেল। তিনি রানীর বাজার-অশোকতলা ও বাগিচাগাঁওয়ের তিন রাস্তার ফোয়ারার সামনে বসেন। ব্যবসা ভালো হলে ১০/১২ হাজার টাকা আর ভালো না হলে ৭/৮ হাজার মুনাফা হয় বলে জানান। এবার একটি খাসিও বিক্রির জন্য এনেছেন।
রাসেলের সর্বশেষ বক্তব্য, ভাই আমাকে ভিক্ষা দেওয়ার দরকার নেই। যারা কোরবানি দেবেন তাদের তো গরুকে খাওয়ানোর জন্য কিংবা ঈদের দিন মাংস কাটার জন্য এই জিনিসগুলো লাগবে। তারা যেন দয়া করে আমার কাছ থেকে কিনে নেন। তাহলেই আমাকে সাহায্য করা হবে। সত্যিই রাসেল আমাদের সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, ব্যক্তিত্ব কাকে বলে। দুই পা ও এক হাতবিহীন রাসেলের যেখানে ভিক্ষা করার কথা ছিল, সেখানে তিনি ভিক্ষা না করে কর্ম করে খাওয়াকেই আদর্শ বলে মনে করছেন। আসলে পড়াশোনা করে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করলেই ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হয় না। প্রকৃত ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে হয়— যা রাসেল আমাদের শিখিয়ে দিলেন।