মোহাম্মদ সোহেল, নোয়াখালী: গরু রপ্তানিতে ভারত কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বাংলাদেশে গরু উৎপাদন বেড়েছে। ফলে দেশের খামারি ও গৃহস্থ লাভবান হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় গেল কয়েক বছর গরু উৎপাদনে লাভের মুখ দেখায় নোয়াখালীতে বেড়েছে গরুর খামার।
খামার ও গৃহস্থ পর্যায়ে সারা বছর গরু পালন করায় এবার কোরবানি উপলক্ষে নোয়াখালীতে এক লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৮ পশু প্রস্তুত করেছেন খামারি ও গৃহস্তরা। জেলায় চাহিদা রয়েছে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯৮৩ পশু। অর্থাৎ জেলার চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকবে ৩০ হাজার ৩৯৫ পশু।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবুল কালাম আজাদ জানান, আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় জেলার খামারিরা চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত কোরবানির পশু প্রস্তুত করেছেন। এরমধ্যে ষাঁড় রয়েছে ৫৩ হাজার ৪০৪টি, বলদ ৩৭ হাজার ৮৯২টি, গাভি ১৩ হাজার ৭৮৮টি, মহিষ সাত হাজার ৪৭৬টি, ছাগল ৪২ হাজার ৩১৬টি, ভেড়া ১২ হাজার ৫০০টি ও অন্যান্য পশু দুটি।
গত কয়েক বছর দেশে ভারতীয় গরু প্রবেশ করায় গরু পালনে হচ্ছেন লাভবান খামারি ও গৃহস্তরা। তাই জেলায় এই বছর গরুর খামার বেড়েছে। গৃহস্ত পর্যায়েও বাড়ানো হয়েছে গরু পালন। তবে জেলায় কতগুলো গরুর খামার রয়েছে বা এই বছর কতগুলো খামার বেড়েছে তার সঠিক তথ্য দিতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
গত কয়েক বছর আগেও জেলার গৃহস্তরা কোরবানির ঈদের সময় বাড়তি ইনকামের আশায় সারা বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ২-৪ টা করে গরু পালন করলেও ঈদের আগ মুহুত্বে চোরাই পথে দেশে ভারতীয় গরু প্রবেশ করায় অনেকটা লোকসান গুণতে হতো তাদের।
ফলে খামার গড়ে তোলা তো দূরের কথা গরু পালনে গৃহস্তরাও নিরাশ হয়ে পড়েন। সেই টানপোড়নের মধ্যে ২০১৮ সালে ৭ একর পতিত জমিতে ৮০টি গরু দিয়ে খামার শুরু করেছেন এডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহিন। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি তাঁকে। শিহাব উদ্দিন শাহিন একজন রাজনীতিবিদ। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি। ছিলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও।
টানা কয়েক বছর শিহাব উদ্দিন শাহিনের খামার থেকে কোরবানির সময় প্রায় ২০০ গরু বিক্রি করে আসছেন তিনি। পতিত জমিতে গরুর খামার করে সফলতা পেয়েছেন তিনি। যার কারণে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তাঁর খামারটি অনুকরণীয় হয়ে ওঠেছে বেকার যুব সমাজ ও ক্ষুদ্র খামারিদের কাছে। তাঁর খামারের নাম দেওয়া হয়েছে মানফাত মিট ক্যাটেল এন্ড ডেইরী ফার্ম।
এই খামার দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে জেলার সদর উপজেলাসহ বৃহত্তর নোয়াখালীতে গড়ে ওঠেছে অর্ধশতাধিক গরুর খামার।
মানফাত মিট ক্যাটেল এন্ড ডেইরী ফার্ম আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিপূর্ণ। শেডের ভেতরে প্রতিটি গরুর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে আলাদা আলাদা চৌবাচ্চা। রয়েছে গরুর গোসল, চিকিৎসা ও প্রজননের জন্য আলাদা ব্যবস্থা।
সদর উপজেলার নোয়াখালী ইউনিয়নের পশ্চিম চর উরিয়া গ্রামের খলিল মিয়ার দরজা এলাকায় গড়ে ওঠা উন্নত ও আধুনিক মানফাত মিট ক্যাটেল এন্ড ডেইরী ফার্ম সবার দৃষ্টি কেড়েছে। পৈত্রিক ব্যবসার সুত্র ধরে খামারটি তৈরি করেছেন এডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহিন।
এই খামারের মালিক এডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহিন বলেন, স্বাধীনতার আগ থেকেই আমাদের পরিবার কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। আমাদের আগে বাথান ছিল, যা এখানো আছে। বর্তমানে বাথানে দেশিয় গরু মহিষ ও ভেড়া রয়েছে। দীর্ঘদিন আমাদের দুধের গাভী ছিল।
আমি সেখান থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। এখানের জায়গাগুলো পতিত জমি ছিল। বছরে একবার ধান চাষ হতো আর সারাবছর পড়ে থাকতো। এই জায়গার বহুমুখী ব্যবহার করার জন্য আমি খামার শুরু করেছি। গরুর পাশাপাশি মাছের খামার ও পোল্ট্রি মুরগির খামার রয়েছে এখানে। ঈদুল আজহাসহ সারাবছরে কিভাবে এ অঞ্চলের মানুষকে পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্য সম্মত গরুর মাংস দেওয়া যায় সেই জন্য খামারটি শুরু করেছি।
শিহাব উদ্দিন শাহিন আরও বলেন, বর্তমানে খামারের ৭ বছর চলছে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে মানুষকে সুস্থ, সবল ও সুঠাম দেহের গরু দিতে পারি তাহলে তাদের মানষিক প্রশান্তির পাশাপাশি আমিও কিছু সাওয়াবের অধিকারী হলাম। আমি খুব লাভের চিন্তা করি না কেননা আমিও এই সমাজের একজন।
মানুষ যদি কোরবানির সময় প্রতারিত না হয়য়ে ভাল, সুষ্ঠু ও সুঠাম দেহের গরু পায় তাহলে সবাই কম বেশি উপকৃত হবে। আমার দেখাদেখি এই অঞ্চলে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি উদ্বুদ্ধ হয়ে খামার গড়ে তুলেছে।
কোরবানি উপলক্ষে ২২টি গরু লালন-পালন করছেন জেলার কোম্পানীগঞ্জের খামারি মো. ফয়সাল। তিনি বলেন, আগের তুলনায় খাদ্য, ওষুধ ও ভ্যাকসিনের চড়া মূল্যের কারণে খরচ অনেক বেশি পড়েছে। এজন্য গরুর দাম আগের তুলনায় একটু বেশি। যারা দেশি গরু দিয়ে কোরবান দেন তারা দাম একটু বেশি হলেও এসব গরুই পছন্দ করবেন।
দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের ২নম্বর ওয়ার্ডের ইসলামপুর গ্রামের খামারি আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই পশুপালনের প্রতি শখ ছিল। তবে বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড হওয়ায় সেভাবে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। দুর্গম এ অঞ্চলে খামার দেওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তারপরও আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। এবারও কোরবানির জন্য পশু প্রস্তুত করেছি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বৃহত্তর নোয়াখালীর (নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর) উপ-পরিচালক ডা. আবদুর রহিম বলেন, নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হয়। এছাড়া এলাকাটি নিচু হওয়ায় পশুপালন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও খামারিরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় এবার ভালো কোরবানির পশু উৎপাদন করেছে।
প্রতিনিধি/একে