স্বকৃত নোমান
জাতীয়তাবাদী চেতনা জাতি গঠনের প্রাথমিক ধাপ। এই ধাপে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, জাতীয় প্রতীকসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আবশ্যক। জাতি গঠন হয়ে গেলে জাতি তখন নিজেদের বিশ্বজাতিতে উত্তরণ ঘটায়। তার মধ্যে তখন আর জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতা থাকে না। তখন জাতিয়তাবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ কিংবা প্রদর্শনের প্রয়োজন পড়ে না। জাতি তখন জাতীয় পতাকা দিয়ে প্যান্ট বানাতে পারবে, আন্ডারওয়ার বানাতে পারবে, জাতীয় পতাকা খচিত জুতাও বানাতে পারবে। তখন বাংলাদেশ-চীন খেলার সময় বাংলাদেশের নাগরিক চীনের পতাকা উড়াতে পারবে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান খেলার সময় বাংলাদেশের নাগরিক পাকিস্তানের পতাকা উড়াতে পারবে। কেননা তখন সে বাঙালি, বাংলাদেশি এবং একই সঙ্গে বিশ্বনাগরিক। বাঙালি জাতি এখনো পূর্ণরূপে গঠিত হয়নি। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের গন্ধ এখনো বাতাস থেকে মিলিয়ে যায়নি। বিস্তর মুক্তিযোদ্ধা এখনো জীবিত। খুনি রাষ্ট্র পাকিস্তান এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। কোনো খেলার সময় বাংলাদেশের কোনো নাগরিক পাকিস্তানের পতাকা উড়ানো কিংবা জার্সি পরা মানে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা। তা ছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো জাতি প্রশ্নে দোদুল্যমান। সে বাঙালি, বাঙালি মুসলমান, না মুসলমান- এ নিয়ে দোদুল্যমান। তার সংশয় কাটানোর জন্য গত পঞ্চাশ বছরে কোনো সরকার যথাযথ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগও এই ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন। প্রজন্মকে প্রস্তুত করার জন্য ছাত্রলীগের যা যা করার দরকার, তারা তা করছে না।
ফলে একটি কিম্ভূতকিমাকার প্রজন্ম গড়ে উঠেছে, যারা জানে না দেশ কী, দেশপ্রেম কী, কীভাবে এই রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিলো। তারা জানে না মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, রক্তের ইতিহাস, লাশের ইতিহাস। জানে না বঙ্গবন্ধুর কথা, জানে না মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। স্বাভাবিক কারণেই তারা বাংলাদেশ-পাকিস্তান খেলার সময় গ্যালারিতে বসে পাকিস্তানের পতাকা ওড়াচ্ছে, পাকিস্তানের জার্সি গায়ে দিচ্ছে। যখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তখন তারা বলছে, ‘আমরা মজা করেছি।’ একটি ভয়ঙ্কর গণহত্যাকেও একদিন তারা ‘মজা’ বলে দিতে পারে। অসম্ভব নয়।
আবার এ কথাও সত্য, এই কিম্ভূতকিমাকার প্রজন্মের একটি অংশকে যতোই দেশপ্রেম শেখানো হোক, যতোই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো হোক, তারা নিজের অবস্থানে অটল থাকবে। কারণ তার নিজস্ব কোনো বিচার-বুদ্ধি নেই, সে সব কিছুকে বিচার করে ধর্ম দিয়ে। তার নিজস্ব কোনো চোখ নেই, সে সব কিছুকে দেখে ধর্মের চোখ দিয়ে। এটা তার জিনগত সমস্যা। বাঙালি তো শংকর। বহু রক্তের মিশ্রণ তার মধ্যে। জিনের এই প্রভাব সহজে সে এড়াবে কেমন করে? আসলেই কি এড়াতে পারবে না? পারবে, অবশ্যই পারবে। পূর্বপুরুষের রক্তগত প্রভাবও মানুষ এড়াতে পারে। তার জন্য প্রয়োজন ইতিহাসের গভীর চর্চা, জাতীয়তাবাদের ভিতকে শক্তিশালী করা এবং যা কিছু শুভ ও মঙ্গলকর, তার সব কিছু তার মধ্যে প্রবিষ্ট করে দেওয়া। তা করা গেলে সে না হোক, তার সন্তান-সন্ততিদের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন যে ঘটবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লেখক : কথাসাহিত্যিক