শিরোনাম
◈ বাংলাদেশ ব্রাজিল থেকে ইথানল নিতে পারে, যা তেলের চেয়ে অনেক সস্তা: রাষ্ট্রদূত ◈ যুক্তরাষ্ট্র সরে এলে বিশ্বরাজনীতিতে নেতৃত্ব দেবে কে: বাইডেন ◈ মিয়ানমার সেনাসহ ২৮৮ জনকে ফেরত পাঠালো বিজিবি ◈ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপির ৬৪ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ◈ বর্ধিত ভাড়ায় ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু ◈ বাড়ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি ◈ আরও তিন মামলায় জামিন পেলেন মামুনুল হক ◈ সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৯ ◈ তাপপ্রবাহে উচ্চ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিশুরা,  বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ ইউনিসেফের ◈ মন্ত্রী ও এমপিদের নিকটাত্মীয়রা প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে: ওবায়দুল কাদের 

প্রকাশিত : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ০৩:৫৭ রাত
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ০৩:৫৭ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

এলএনজির পর দুশ্চিন্তার নতুন কারণ জ্বালানি তেলের দরবৃদ্ধি

বণিক বার্তা: তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম এখন রেকর্ড সর্বোচ্চে। স্বাভাবিক বাজারগতি অনুযায়ী বিকল্প পণ্য অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের চাহিদা ও দামেও এখন ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে সব বাজার আদর্শে পণ্যটির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারের কাছাকাছি। বিষয়টি এখন দেশে নতুন করে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। এলএনজির দরের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি দেশে বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে জ্বালানি তেলের চাহিদা ও ব্যবহার দুটোই বাড়িয়েছে। কিন্তু পণ্যটির দাম বাড়তে থাকায় সামনের দিনগুলোয় বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে জ্বালানির সংকটজনিত চাপ আরো জোরালো হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও রাষ্ট্রীয়ভাবে পণ্যটির একক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে এ মুহূর্তে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কথা ভাবছে না সংস্থাটি।

দেশে জ্বালানি তেলের ৯২ শতাংশই পূরণ করতে হয় আমদানির মাধ্যমে। এলএনজির দাম বাড়ায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমিয়ে জ্বালানি তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। বাড়তি চাহিদা মেটাতে এরই মধ্যে অতিরিক্ত ৪০ হাজার টন ফার্নেস অয়েল আমদানির চাহিদাপত্র দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। অন্যদিকে পরিবহন খাতেও জ্বালানি তেলের চাহিদা এখন বাড়ছে। সিএনজি স্টেশনগুলো খোলা রাখার সময়সীমা কমিয়ে দেয়ায় ব্যবহার বাড়তে শুরু করেছে পণ্যটির। ঠিক এমন মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের অব্যাহত মূল্যের গতি নতুন করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে।

অন্যদিকে মূল্য সমন্বয় না করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার বিষয়টিও বিপিসির জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। বাজার বিশ্লেষক প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই পূর্বাভাস দিয়েছে, সামনের দিনগুলোয় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরো বাড়বে। মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের শেষ দিকে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলারও ছাড়িয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশের বাজারে মূল্য সমন্বয় না করলে আর্থিকভাবে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়বে বিপিসি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের যে ঊর্ধ্বগতি সেটি আমরা ফলোআপ করছি। নতুন বছরে যখন আমরা জ্বালানি তেল আমদানি করব, তখনকার মূল্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা পরিকল্পনা গ্রহণ করব। এখন পর্যন্ত আমাদের জ্বালানি তেলের দাম যে অবস্থায় আছে, সেটি থাকবে। মূলত এটি প্রডাক্ট বাই প্রডাক্ট চেঞ্জ হচ্ছে। ডিজেল ও অকটেনে খুব একটা পরিবর্তন নেই। ফার্নেস অয়েলের দামে পরিবর্তন হচ্ছে। এটি আমরা খোলাবাজার থেকে আমদানি করি। ফলে এটির পরিবর্তন হতে পারে।

তিনি আরো বলেন, জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমদানির যে চ্যানেল সেটি আমরা অব্যাহত রেখেছি। আগামী নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আরো অনেক কার্গো আসবে। ফলে আমদানিতেও আমাদের কোনো ধরনের জটিলতা নেই। তবে আমাদের আমদানি চুক্তির বাইরে আমরা নতুন করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অতিরিক্ত ফার্নেস অয়েল নিয়ে আসছি।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে বিপিসি এরই মধ্যে লোকসানে পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় দুই মাস ধরে বিপিসির জ্বালানি তেল বিক্রিতে লোকসান বেড়ে গেছে। জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭২ ডলারের বেশি হলে বিপিসি লোকসানে চলে যায়। বিপিসি যে জ্বালানি তেল আমদানি করে তাতে ভ্যাট ও ট্যাক্স নির্ধারণ করেই মূলত পণ্যটির মূল্য প্রক্ষেপণ করা হয়। যখন এ ভ্যাট-ট্যাক্স মূল্যের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন পণ্যটির দাম আরো বেড়ে যায়।

বিপিসির আমদানীকৃত জ্বালানি তেলের ৫০ শতাংশ আসে জি-টু-জি চুক্তির ভিত্তিতে। বাকি অর্ধেক আসে খোলাবাজার থেকে। বিভিন্ন দেশের সাতটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এ জ্বালানি তেল সরবরাহ করে। আমদানীকৃত এ তেল পরিশোধন হয় ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধনাগারে। এরপর তা রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটি বিপণন কোম্পানির মাধ্যমে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের ৬৫ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে পরিবহন খাতে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতেও এখন জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ছে।

বর্তমানে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় ডিজেলভিত্তিক ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৮০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে বিপিডিবি। এতে প্রতিদিন ডিজেল ব্যবহার হচ্ছে প্রায় ৪০ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে মাসে ডিজেলের প্রয়োজন পড়ছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার।

এছাড়া ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়ও অধিকাংশ জ্বালানি ব্যবহার হচ্ছে সরাসরি আমদানির মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে ফার্নেস অয়েলের দাম ওঠানামা করছে প্রতি টন ৪৫০-৫০০ ডলারে। আমদানি পর্যায়ে পণ্যটিতে ৩২ শতাংশ শুল্ক ও কর আরোপ করায় বিপিডিবির ব্যয়ও বিপুল পরিমাণ বেড়েছে। এরই মধ্যে বিদ্যুতে আর্থিক সহায়তা বাবদ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে চলতি অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে বিপিডিবি।

এ বিষয়ে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, গ্যাস সংকটে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেশি হলেও গ্যাসের বিকল্প সংস্থান হিসেবে জ্বালানি তেলভিত্তিক এসব কেন্দ্র চালানো হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কভিড প্রাদুর্ভাবের পর দীর্ঘ সময় দেশের শিল্প-কারখানা, স্থল-আকাশপথ ও জলপথ বন্ধ থাকায় জ্বালানি তেলের ব্যবহার কম ছিল। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পাশাপাশি পরিবহনসহ সব ধরনের যানবাহন খুলে দেয়ায় এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জ্বালানির প্রয়োজন হবে। এমন সময় জ্বালানি তেলের মূল্যে ঊর্ধ্বগতি দেশের পরিবহন খাতসহ শিল্প ও কৃষিকে আর্থিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দেবে।

কভিড মহামারীতে গত বছরের অক্টোবর থেকে বিশ্বব্যাপী দাম পড়তে থাকে জ্বালানি তেলের। সে সময় প্রতি ব্যারেল ক্রুড অয়েলের দাম ৫০ থেকে ৪০-৪২ ডলারে নেমে যায়। ধারণা করা হয়েছিল, পরে পণ্যটির দাম আরো পড়ে যাবে। তবে বিশ্বব্যাপী করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর পণ্যটির মূল্যসূচকে উল্টো গতি দেখা যায়। এরপর গত এক বছরে পণ্যটির দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে।

অয়েলপ্রাইসটুডেডটকমের হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, গতকাল নিউইয়র্কের বাজারে মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) বেচাকেনা হয়েছে প্রতি ব্যারেল ৭৫ ডলার ৬১ সেন্টে। এছাড়া ইউরোপের আইসিই ফিউচার্স এক্সচেঞ্জে ব্রেন্ট বিক্রি হয়েছে ৭৯ ডলার ৩০ সেন্টে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মূলত মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি পণ্য আমদানি করে। কয়েকটি জ্বালানি তেল রফতানিকারক সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির জ্বালানি তেলের দাম ৭৫-৭৭ ডলারে ওঠানামা করছে। এশিয়ার বাজারে তেল সরবরাহকারী বড় রফতানিকারক সৌদি এক্সট্রা লাইট প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের মূল্য ৭৬ ডলার ৯১ সেন্ট উঠে গেছে। এছাড়া আরব হেভি ৭৫ ডলার ৩১ সেন্টে বিক্রি হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল রফতানিকারক আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির জ্বালানি তেল রফতানি সংস্থা ডাশের প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৭৫ ডলার ৫০ সেন্ট এবং আপার জাকুম ব্যারেলপ্রতি ৭৫ ডলার ২০ সেন্টে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম চলতি মাসে ব্যারেলপ্রতি বেড়েছে ৫-৬ ডলার, যা এ মাসের শুরুতেই ছিল ৭০ ডলারের কিছু বেশি।

বিপিসি দেশের বাজারে সরবরাহের জন্য আমদানীকৃত তেল রিফাইনারির মাধ্যমে ডিজেল ও অকটেন উৎপাদন করে। এর বাইরে জেট ফুয়েল আমদানি করে। পিটিএলসিএল, ইএনওসি, বিএসপি, পেট্রোচায়না, ইউনিপেক, পিআইটিটি ও কেপিসি মোট সাতটি বিদেশী তেল সরবরাহকারী সংস্থার কাছ থেকে মেয়াদি চুক্তির আওতায় পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, বিশ্ববাজারে বাড়লেও এ মুহূর্তে আসলে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর তেমন সুযোগ নেই। কারণ যে সময় তেলের দাম কম ছিল, সে সময় বিপিসি বর্তমান দামেই বিক্রি করেছে। ফলে তেল বিক্রিতে তারা মুনাফাও করেছে। তবে অতিরিক্ত যে বৃদ্ধি সেটির প্রভাব পড়তে কিছুটা সময় লাগতে পারে।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়