বিমল সরকার: ফাতেমা জিন্নাহ (১৮৯৩-১৯৬৭)। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ছাড়াও তাঁর একটি বড় পরিচয় যে তিনি ষাটের দশকে সামরিক শাসক আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধীদলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্ধন্দ্বিতা করেছিলেন। পুরো নাম ফাতেমা আলী জিন্নাহ, ফাতেমা জিন্নাহ নামে সমধিক পরিচিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে ফাতেমা জিন্নাহ ১৯২৩ সালে বোম্বেতে একটি ডেন্টাল ক্লিনিক চালু করে ওখানে একজন সার্জন হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯২৯ সালে জ্যেষ্ঠভ্রাতা জিন্নাহর স্ত্রী রতনবাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁদের একমাত্র কন্যা দীনা ও বড়ভাইকে দেখাশুনার জন্যে ক্লিনিক বন্ধ ও অন্যসব বাদ দিয়ে তাঁদের সঙ্গে অবস্থান করেন। তিনি বড়ভাইয়ের সহকর্মী ও উপদেষ্ঠা হিসেবে কাজ করেন। পাকিস্তান আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে। স্বাধীনতার পর তিনি পাকিস্তান ওমেনস এসোসিয়েশন গঠন করেন। জিন্নাহর মৃত্যুর পর রাজনীতি থেকে অনেকটা গুটিয়ে রাখেন নিজেকে।
রাষ্ট্রক্ষমতায় স্বৈরাচার আইয়ূব খানের উত্থানের পর রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হন এবং আট বছর (১৯৬০-১৯৬৭) তিনি ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা। ইতোমধ্যে আইয়ূব খান দেশে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ প্রবর্তন করেন। বহুল আলোচিত ‘হ্যাঁ-না’ ভোট সম্পন্ন হয়েছে, সম্পন্ন হয়েছে ইউনিয়ন কাউন্সিল ও পার্লামেন্ট নির্বাচনও। এবার একই পদ্ধতিতে (মৌলিক গণতন্ত্র) দেশজুড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তোড়জোর। আকস্মিক নির্বাচনের ঘোষণায় বিরোধী দলগুলো প্রমাদ গোনে। আইয়ূব খানকে উৎখাতের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে আইয়ূব বিরোধী মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠন করা হয় সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) নামে একটি রাজনৈতিক মোর্চা। কপের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো হলো : আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, নেজামে ইসলাম ও জামাতে ইসলাম। মোর্চার নেতৃবৃন্দ অনেক চেষ্টা করেও ক্ষমতাসীন আইয়ূব খানের বিপরীতে প্রেসিডেন্ট পদে একক প্রার্থী দিতে ঐকমত্যে পৌঁছতে না পেরে তারা একমত হন যে ফাতেমা জিন্নাহকে যদি প্রার্থী হতে সম্মত করা যায়।
মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে খাজা নাজিমুদ্দিন ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ একদল নেতা করাচীতে ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, বিশেষ করে সামরিক শাসককে উৎখাতের লক্ষ্যে প্রতিদ্ধন্দ্বিতা করার প্রস্তাব দেন এবং তিনি এতে সম্মত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৭১ বছর বয়স্কা পাকিস্তানি একজন মুসলিম নারী প্রতিদ্ধন্দ্বিতা করছেন- এ এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। নেতৃবৃন্দসহ ফাতেমা জিন্নাহ পশ্চিম পাকিস্তানের মতোই পূর্ব পাকিস্তানেরও বিভিন্ন স্থানে লাখ লাখ লোকের সমর্থন ও ভালোবাসা পান এবং তাদের সামনে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেনাশাসক আইয়ূব খানেরই বিজয় হয়। আইয়ূব খানের উপর রাষ্ট্রযন্ত্রের সরাসরি মদদ এবং ফাতেমা জিন্নাহর প্রতি রক্ষণশীল ভোটারদের অনীহা ভোটের ফলাফল নির্ধারনের মূল নিয়ামক হয়ে উঠে। ৭৪ বছর বয়সে ১৯৬৭ সালে করাচিতে তাঁর মৃত্যু হয়। ফেসবুক থেকে