নিউজ ডেস্ক: প্রণোদনার অর্থ বিতরণের পরও বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে কাক্সিক্ষত মাত্রার প্রায় অর্ধেকে। ব্যাংক খাত থেকে ঘোষণা অনুযায়ী ঋণ নিচ্ছে না সরকারও। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতে তৈরি হয়েছে অলস তারল্যের স্তূপ। গত জুন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে ব্যাংকগুলোর অলস পড়ে আছে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। একই সময়ে উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। এই অবস্থায় বাজার থেকে টাকা তুলতে দীর্ঘদিন পর ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদী ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ ছাড়া হচ্ছে। আড়াই বছর বন্ধ থাকার পর আগামীকাল সোমবার থেকে এ বিলের নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশে ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে এই বিল বিক্রি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত টাকা তুলে নেবে। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো মুনাফা পাবে। এর মাধ্যমে ঠিক কত টাকা তুলে নেয়া হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও সেটা নির্ধারণ করেনি। তবে এই বিলের সুদহার যদি ট্রেজারি বিল ও কল মানির চেয়ে কম হয়, তাহলে কোন কাজে দেবে না মনে করছেন বেসরকারী খাতের ব্যাংকাররা। জনকণ্ঠ
জানা যায়, দেড় বছর আগেও তীব্র তারল্য সঙ্কটে ভুগছিল দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক। নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) ও সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (এসএলআর) সংরক্ষণেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল বেসরকারী ব্যাংকগুলো। তারল্যের সংস্থান করতে বেশি সুদে অন্য ব্যাংকের আমানত বাগিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন ব্যাংকগুলো। আর এখন এর ঠিক উল্টো চিত্র ব্যাংকগুলোতে। বেশিরভাগ ব্যাংক আমানতের সুদহার কমিয়ে ৪ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে। আবার কোন কোন ব্যাংক ৫-৬ শতাংশ সুদে বড় গ্রাহকদের ঋণও দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আশানুরূপ ঋণ চাহিদা না থাকায় গত জুন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে ব্যাংকগুলোর অলস পড়ে আছে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। একই সময়ে উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। অতিরিক্ত তারল্য নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বলে জানান দি সিটি ব্যাংক লিমিটেডের শীর্ষ নির্বাহী মাসরুর আরেফিন। তিনি বলেন, ‘নতুন বিনিয়োগের জন্য আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু ভাল ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। অন্যদিকে যারা ঋণ নিতে চাচ্ছেন, তাদের অতীত কর্মকান্ডের কারণে ঋণ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ পরিস্থিতির কারণেই দেশের ব্যাংক খাতে অলস তারল্যের পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, সিটি ব্যাংকে এ মুহূর্তে ৩ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। বড় গ্রাহকদের ৫-৬ শতাংশ সুদেও ঋণ দেয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত তারল্য ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘সরকার স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নিয়ে ব্যয় নির্বাহ করছে। এ কারণে ব্যাংক থেকে অর্থের জোগান দেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। এটি সরকারের দিক থেকে ভাল। তবে বেসরকারী খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। এজন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দরকার।’
জানা যায়, গত অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। তবে বছরের শুরু থেকেই ঋণের চাহিদা কম থাকায় এ লক্ষ্য কাটছাঁট করে ৭৯ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে মাত্র ২৬ হাজার ৭৮ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ কম। জানা গেছে, ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত তারল্যের অর্থ বিনিয়োগ করে মূলত সরকারী বিল-বন্ড বা কলমানি বাজারে। কিন্তু বর্তমানে ট্রেজারি বিলের সুদহার নেমে এসেছে ১ শতাংশের নিচে। ট্রেজারি বিলের মতোই সুদহারে পতন হয়েছে বন্ডে। ২ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদহার ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারের সুদহারও নেমেছে ১ শতাংশে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা অতিরিক্ত টাকা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামীকাল সোমবার থেকে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ এর মাধ্যমে ব্যাংক থেকে এই টাকা তুলে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এর মাধ্যমে ঠিক কত টাকা তুলে নেয়া হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও সেটা নির্ধারণ করেনি। এর আগে সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলে নামমাত্র সুদে লেনদেন হয়েছিল। ওইদিন একটি ব্যাংক মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশ সুদে ৭ দিনের জন্য ১৫০ কোটি টাকা রেখেছিল। এরপর থেকে নিলাম প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোকে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’-এ অংশগ্রহণের জন্য চিঠি দিয়ে বলেছে, মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে বাজারে অতিরিক্ত তারল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের নিলাম অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশে ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে এই বিল বিক্রি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত টাকা তুলে নেবে। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো মুনাফা পাবে। এর আগে গত ২৯ জুলাই চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণায় বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, অতিরিক্ত তারল্য আর্থিক খাতে বুদবুদ তৈরি করলে তা তুলে নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। অতিরিক্ত তারল্যের কারণে মূল্যস্ফীতি বা সম্পদের দাম বেড়ে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নীতি গ্রহণে দ্বিধা করবে না।