ফিরোজ আহমেদ: কাঁচা ক্রোধ ও কাঁচা আবেগ কোনোটাই আমাদের রক্ষা করবে না। ঘটনার মানবিক বিবরণ যেমন দরকার, তেমনি সাংবাদিকতার একটা বড় দায় আছে এই দুর্ঘটনার নামে হত্যাকাণ্ডগুলোর পূর্বপশ্চাৎ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা বিষয়ে উন্মোচন করা এবং রাষ্ট্র ঘটনা থেকে দায়মুক্তির জন্য যে নাটকগুলোর আয়োজন করে, সেগুলোর পূর্বাপর নজর রাখা। সংবাদ ভাষ্যগুলো বিষয়েও একই কথা। তিনটা বিষয় খেয়াল করেন, একটা হলো কারখানার পরিদর্শক যারা ছিলেন সরকারি তরফে, তাদের যারা কর্তা ছিলেন, সেই সব সরকারি কর্মচারীদের জবাবদিহিতা। একটা হলো রিমান্ড নামের নাটক দিয়ে মানুষের ক্রোধকে খোরাকি দেওয়া। একটা হলো ফায়ার ব্রিগেড ইত্যাদির সামর্থ্য নিয়ে আলোচনা। দেখবেন প্রথমটা সব চাইতে কম, দ্বিতীয় আর তৃতীয়টা সব চাইতে বেশি। আগুনকে যদি ভয়াবহতম রোগের সঙ্গে তুলনা করেন, একে নেভাবার চাইতে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাটা বেশি জরুরি। সেইখানেই আসল দায়ী ব্যক্তিরারূপী জীবানুরা লুকিয়ে আছেন, এই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড যাদের কারণে ঘটতে পারছে।
নিহত মানুষগুলোর সঙ্গে দেশবাসীর সংবদেনকে ভাষা দিতে তাই সরেজমিন তদন্ত দরকার। কিন্তু অনুসন্ধানী প্রতিবেদকের কাজ হলো এই্ কারখানাগুলো নিয়ে কারখানাগুলোর নিয়মিত তদারক যারা করেন, সেই সব সরকারি পরিদর্শকদের লিখিত প্রতিবেদনগুলো হাজির করা। এবং মনে রাখবেন, মাঠপর্যায়ের বেচারাদের সামনে ঠেলে দিলেই শুধু চলবে না, উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত কীভাবে কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ বজায় আছে, সেটার সনদের বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকার লেনদেন এদেশে চলছে, সেটার চিত্রটি উন্মোচন করা।
হাশেম সাহেবের রিমান্ড কিংবা ...কিছু পুরনো নাটক। তার সরকারি যোগাযোগ অটুট থাকলে কিছু অর্থব্যয় সহকারে বেরিয়ে আসবেন। যোগাযোগ খারাপ থাকলে বেশি টাকা। কিন্তু এতে কারখানার চিত্র বদলাবে না। একটা ব্যতীত কোনো ঝুঁকি কোনকালে কারখানার মালিকদের কর্মস্থলে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করাতে পারেনি। সেই একটা ঝুঁকি হলো কারখানা বন্ধ করে দেওয়া। কারখানায় আগুন প্রতিরোধ এবং অন্যান্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের দায় সরকারের। এককভাবে। তারা যদি সেটা না করে কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের জীবন নিয়ে, কখনো কখনো নিজেদের সম্পদ নিয়েও, জুয়া খেলেতই থাকবে। ঝুকির মাত্রা জানা থাকলেও করবে। শিল্প উৎপাদনের ইতিহাসে এটা হাজারো বার ঘটেছে। কারখানা পরিদর্শনের প্রথা ইউরোপের শুরুই হয়েছিল তিনটা কারণে, একটা শিশু শ্রম নিবারণ, একটা কর্মপরিবেশ, আরেকটা দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ। আবারও বলছি, এটা সরকারের একক দায়।
রিমান্ড বিষয়ে খেয়াল করুন। ঘটনা যা ঘটেছে, সে বিষয়ে রিমান্ডে কী কী তথ্য পাবেন বলে আশা করেন? যা যা জানার তার বড় অংশ জানা যাবে রাসয়নিক পরীক্ষার মাধ্যমে। বাকি সকল ঘটনা তো চোখের সামনে ঘটেছে। বরং এই কারখানার সরকারি পরিদর্শকরা কী কী বলেছেন কারখানার পরিস্থিতি নিয়ে, সেগুলোতে ঝুঁকি সম্পর্কে কিছু বলা আছে কিনা, বলা থাকলে কারা কারা সেই কারখানা বন্ধ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, ঝুঁকি বিষয়ে না বলা থাকলে কীসের বিনিময়ে তারা বলেননি, পরিদর্শকরা দুর্নীতি করে থাকলে সেটার সাথে ঊর্ধতনরা জড়িত কিনা, এক্ষেত্রে দুর্নীতি হলে কারা কারা মিলে করেন, সেগুলোর জন্য তদন্ত-রিমান্ড-বিচার এবং এই সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো ব্যবহার করে হাশিম ও তার সহচরদের শাস্তি নিশ্চিত করাটা দরকার। একইসঙ্গে প্রয়োজন সরকারি এই সচিব/অতিরিক্ত সচিব থেকে শুরু করে কারখানা পরিদর্শক পর্যন্ত সকল কর্মচারি যেন ভবিষ্যতে এমন বিপজ্জনক দুর্নীতির সাহস না করতে পারে, সেটা নিশ্চত করা। বরং অধিকাংশ পত্রিকার চাইতে, তাদের সংবাদভাষ্যগুলোর চাইতে আইএলওর বিবৃতিটা অনেক বেশি ভালো। লেখক : রাজনীতিবিদ। ফেসবুক থেকে