সুজন কৈরী : আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী পরিচয় দেয়া ভুয়া বিজ্ঞানী সাইফুল ইসলাম ওরফে বিজ্ঞানী সাইফুল ওরফে সায়েন্টিস্ট সাইফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তার চক্রের আরও ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাব বলছে, আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানীর ভুয়া পরিচয়ে স্ব-উদ্ভাবিত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-প্রতিকার, পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রজেক্ট, করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও অন্যান্য প্রজেক্ট বাস্তবায়নের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন সাইফুল। এছাড়া তিনি জমি আত্মসাতও করতেন।
সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১ মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত ঢাকা ও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রতারণার জন্য রাজধানীর উত্তরা এলাকার রাজা-বাদশা গ্রুপের নতুন কার্যালয় খুলেছিলেন। সেখান থেকে প্রতারক চক্রের মূলহোতা সাইফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- বকুলি ইয়াসমিন (৪৬), ইমরান রাজা (২৫), কাকুলী আক্তার (১৯), রামান বাদশা (১৮), আনিসুজ্জামান সিদ্দীকী (৫৩), নাজমুল হক (৩০), তারেক আজিজ (৪০), বেল্লাল হোসেন (৬১), আব্দুল মান্নান (৫০), শিমুল মিয়া (২৪), নুরনবী (৪৫), আবুল হাশেম (৪২), আলী হোসেন (৩৮), শওকত আলী (৫০) ও রোকনুজ্জামান (৫০)। তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, ২ রাউন্ড গোলাবারুদ, ২ বোতল বিদেশি মদ, ৬টি সীল, নগদ ৪৫ হাজার ৪৬০ টাকা, ২০টি মোবাইল ফোন, ১৪টি চেক বই, ১২টি ভিজিটিং কার্ড, ৬টি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চিঠি, বিভিন্ন মূল্যের ১২১টি জাল স্ট্যাম্প, ৩টি চুক্তিনামা দলিল, ৩টি বই এবং ৯টি স্বাক্ষরিত চেক ও বিদেশি নেতাদের সাথে পত্রালাপের ভুয়া কপি উদ্ধার করা হয়েছে।
বুধবার বিকালে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার সাইফুল রাজা-বাদশা গ্রুপের নামে ভুয়া সংগঠন তৈরি করে ২০১১ সাল থেকে প্রতারণার কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। তিনি ওই গ্রুপের চেয়ারম্যান বলে পরিচয় দেন। এই চক্রের সাথে তার পরিবারের সদস্যরাও ওতোপ্রতভাবে জড়িত। তার মধ্যে স্ত্রী বকুলী, ছেলে ইমরান ও রোমান এবং পূত্রবধূ কাকুলী ভুয়া সংস্থাটির গুরুত্বর্পূর্ণ পদে রয়েছেন।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তার সাইফুলের শিক্ষগত যোগ্যতা বিএসসি পাশ। তিনি প্রথমে টিউশনি ও পরে পোল্ট্রি ফিড ব্যবসা করতেন। দীর্ঘ ১০ থেকে ১১ বছর ধরে বিভিন্ন প্রতারণার সাথে জড়িত। তার নামে বিভিন্ন থানায় ৫টি প্রতারণার মামলা রয়েছে। তিনি নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক স্বনামধন্য বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভিকটিমদের প্রলুব্ধ করতেন। তিনি বলতেন, বিদেশে তার বিভিন্ন আবিষ্কার ও গবেষণা ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। এছাড়া তার প্রতিষ্ঠান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রতিকার ও জ্বালানীবিহীন জেনারেটর দিয়ে পরিচালিত পাওয়ার প্ল্যান্ট ও করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থার উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। তিনি ভিকটিমদের কাছে বিশ্বাস যোগ্যভাবে উপস্থাপন করতেন যে, করোনা প্রতিরোধে তার কয়েল টেকনিক পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী করোনা প্রতিরোধে ব্যাপক ভুমিকা রাখবে।
সাইফুল আরও উল্লেখ করতেন, তার প্রজেক্টগুলো বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ সংক্রান্তে বিভিন্ন ভুয়া পত্রালাপগুলো তিনি উপস্থাপন করতেন। তার সাথে বিদেশি বিজ্ঞানী, গবেষক ও নেতাদের যোগাযোগ রয়েছে দাবি করতেন সাইফুল। যারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে সম্মত রয়েছেন বলে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করতেন। ভিকটিমদের বিশ্বাসযোগ্যাতা অর্জন করাতে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়ের এরদোগান ছাড়াও সৌদি আরবের তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং সাইপ্রাস ও জাপানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম উদ্ধৃত করতেন। এছাড়াও ইরাকের এক আইনজীবি তার উদ্ভাবিত প্রজেক্টে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে ইচ্ছা পোষণ করেছেন বলে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন তথ্য উপস্থাপন করে প্রতারনা করতেন।
র্যাব জানায়, প্রতারক সংগঠনটির মূল কার্যালয় উত্তরায় অবস্থিত (নব স্থাপিত)। এছাড়া টাঙ্গাইলের বেপারী পাড়ায় একটি শাখা রয়েছে। অফিসের ১৫ জন সহযোগী কর্মরত। মাঠ পর্যায়ে আরও ৩০ জনের অধিক নিয়োগপ্রাপ্ত রয়েছে। মাঠ পর্যায়ের এজেন্টরা প্রাথমিক আলোচনা করে টার্গেট নির্ধারণ করতেন। এরপর গ্রুপ বা কোম্পানী চেয়ারম্যান সাইফুলের সঙ্গে সাক্ষাত করাতেন। পরে সাইফুল ভিকটিমদের বিভিন্ন প্রতারণার ফাঁদে ফেলতেন।
ভিকটিমদেরকে মূলত সাইফুল স্ব-উদ্ভাবিত জলবায়ু পরিবর্তন প্রজেক্ট, বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন, পরিবেশ বান্ধব যানবাহন, ডায়াবেটিক নিরাময় প্রতিষেধক, হৃদরোগ নিরাময় প্রতিষেধক প্রজেক্ট, করেনা নিরাময় কয়েল টেকনিক প্রজেক্টের বিনিয়োগে প্রলুদ্ধ করতেন সাইফুল। প্রজেক্টগুলোর অর্থ বিনিয়োগে ২৫ হাজার হলে কোটি টাকার অফার এবং জমি প্রদানে প্রজেক্টের মালিকানা শেয়ারের অফার দিতেন। স্বল্প শিক্ষিত ধনী ব্যবসায়ী ও জমিজমা সম্পত্তির মালিকদের সাইফুল টার্গেট করতেন।
ইতিমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রজেক্টের আওতায় নোয়াখালীতে প্রায় ৪৫০ বিঘা জমি ছাড়াও লক্ষীপুর, রাজশাহী এবং ময়মনসিংয়ের ভালুকায় আরও সহস্রাধিক বিঘা জমি প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের চেষ্টা করেছিলেন। এছাড়া পাহাড়ি এলাকায়ও জমি জালিয়াতির চেষ্টা করেছিলেন বলে জানিয়েছেন সাইফুল। প্রায় কয়েক শতাধিক ভিকটিম সাইফুলের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছে ধারণা করছে র্যাব।