ডা. আরমান রহমান, ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড থেকে : ইদানিং ‘গেইন অব ফাংশন গবেষণা’ বলে একটা কথা প্রায়শই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এটা সত্যিকার অর্থে কী তা পরিষ্কার করে জানতে হলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্মন্ধে ধারণা থাকা জরুরি। এই কথাটা ইদানীং আলোচনায় আসার কারণ হচ্ছে, অনেকেই ধারণা করেন- সার্স কোভ-২ ভাইরাস চায়নার ল্যাবে বানানো হয়েছে। আমেরিকা চায়নাকে চাপের মধ্যে রাখার জন্য প্রায়ই দেখবেন, এই তত্ত্বের আলোচনার অবতারণা করা হচ্ছে।
‘গেইন অব ফাংশন গবেষণা’ সাধারণত যেকোনো অর্গানিজম নিয়েই হতে পারে, কিন্তু এটা ভাইরাস নিয়ে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। একটা ভাইরাসকে ল্যাবের ভেতর নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে বারবার একই ধরনের সেলকে ইনফেক্ট করতে দিলে সে তার জিন সিকোয়েন্স বদলে আরও শক্তিশালী অথবা আরও দ্রুত ইনফেকশন ছড়াবার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এই ক্ষমতা কোন কোন জিনের মিউটেশনের ওপর ভিত্তি করে হচ্ছে তা দেখাই এই গবেষণার লক্ষ্য ছিলো।
এর ওপর ভিত্তি করেই যাতে ভবিষ্যতের টিকা অথবা ওষুধ আবিষ্কার করা যায়, এই লক্ষেই এই গবেষণা চালানো হতো। যেমন ধরেন সার্স কোভ-২ ভাইরাসের ‘ই-৪৮৪কে’ মিউটেশনের কারণে স্পাইক প্রোটিন আমাদের শরীরের এ সি ই-২ রিসেপ্টরকে আরো শক্ত করে ধরে এবং এটা শরীরের ইমুইন সিস্টেমকে ফাঁকি দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
এই মিউটেশন যদি আপনি ল্যাবের ভেতর পরীক্ষার মাধ্যমে এই ভাইরাসের সিকোয়েন্সে আনতে পারেন, সেটাই ‘গেইন অব ফাংশন রিসার্চ’। ধরেন এফডিএ’র নিয়ম হলো ভ্যাক্সিন তৈরি করতে হলে আগে তা কোনো প্রাণির শরীরে পরীক্ষা করতে হবে। এখন যেই সমস্ত প্রাণি ল্যাবে ভ্যাক্সিন টেস্টের কাজে লাগানো হয়, মানুষের ভাইরাস তাদের ইনফেক্ট নাও করতে পারে, তাহলে কী করা যায়? এই গেইন অব ফাংশন রিসার্সের মাধ্যমে আপনি ভাইরাসের সিকোয়েন্সে এমন মিউটেশন আনবেন, যাতে সেই ভাইরাস এখন এই নতুন প্রজাতিকে ইনফেক্ট করার ক্ষমতা অর্জন করবে।
এখানে জেনে রাখা ভালো, ভাইরাসের জীন সিকোয়েন্স এমনিতেই এলোমেলো ভাবে (রেন্ডমলি) মিউটেশন হতে থাকে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুনির্দষ্ট স্থানে পরিকল্পিতভাবে মিউটেশন ঘটানোর সক্ষমতা অনেক দেশের বৈজ্ঞানিকদের হাতেই আছে (যেমন সাইট ডাইরেক্টেড মিউটাজেনেসিস)।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১২ সালের সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলের কথা। এই আর্টিকেলে সায়েন্টিস্টরা দেখিয়েছেন, একটি ইনফুয়েঞ্জা ভাইরাস (হেইচ ৫ এন ১) যা বেজীকে (ফেরেট) আক্রান্ত করতে পারতো, ল্যাবে তার মিউটেশন ঘটিয়ে তারা এটাকে বায়ু পরিবাহিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
মিউটেটেড ভাইরাস আক্রান্ত বেজির নিঃশ্বাসের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছিলো, যা অরিজিনাল ভাইরাস আক্রান্ত বেজির পক্ষে সম্ভব হতো না। তারা দেখাতে চেয়েছিলেন যে, মিউটেশন হলে ভাইরাস বায়ু পরিবাহিত হয়ে যেতে পারে এবং কোন কোন ওষুধ এই ভাইরাসের জন্যে ভালো কাজ করবে, সেটা। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনৈতিক ব্যবহারের কথা ভেবে ২০১৪ সালে বারাক ওবামা এই গবেষণার সমস্ত অর্থায়ন বন্ধ করে দেন. যদিও ডোনাল্ড ট্রামের আমলে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে হয়েছে। গেইন অব ফাংশন গবেষণার এটি একটি টেক্সট বুক এক্সাম্পল।
যেকোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা তা যতো ভালো চিন্তা করেই শুরু করা হোক না কেন, তার ভবিষ্যৎ ব্যবহার কী হতে পারে, এটা নির্ধারণের জন্য সব দেশের সব প্রতিষ্ঠানেই একটি এথিকেল কমিটি থাকে। এই এথিকেল কমিটি ঠিক করে দেয়, কোন গবেষণা করা যাবে, কোন গবেষণা করার দরকার নেই। দেখা যায়, গেইন অব ফাংশন গবেষণার খারাপ ব্যবহারের কথা চিন্তা করে পৃথিবীর অনেক দেশেই এটাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :