মাহবুবুল আলম: [২] করোনার ভয়াল থাবা সমগ্র পৃথিবীজুড়ে যে স্থবিরতা বয়ে এনেছে তাতে একুশ শতকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা মানুষকে ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সাময়িকভাবে করেছে
গৃহবন্দি।
[৩] আবেগের বিনিময়ে বেগ দেয়া এই সভ্যতায় একক আর বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপনে অভ্যস্ত আমাদের এই সংকটকালীন সময়ে জাগরূক হয়েছে মধুময় সোনালী স্মৃতি ।
[৪] ব্রহ্মপুত্র নদ বিধৌত পলিমাটি সমৃদ্ধ সবুজ শ্যামল ময়মনসিংহের চর খরিচা গ্রামে কেটেছে আমার রঙিন শৈশব ও কৈশোরের স্মতিময় দিনগুলি । পূর্ব দিকের মাইল খানেক লম্বা ধানের মাঠ আর জলা পেরিয়ে যেতে হতো। দৃশ্যটা চিরায়ত গৃহস্থ বাড়ির মতই ।
[৫] নারিকেল-তাল-সুপারি, আম-কাঁঠাল, জাম-জলপাই, বেল, বাশঁঝাড়ে ঘেরা আমাদের বাড়ি ।
[৬] দাদা-দাদি, চাচা-চাচি সবার সঙ্গে যৌথ-পরিবারে বয়োজেষ্ঠ্যদের শাসনের সঙ্গে স্নেহ- ভালবাসা আমাদের শৈশবের শুরুর দিনগুলিকে করেছিল রঙিনতর । সারাদিনের খেলাধুলা শেষে সন্ধ্যায় সব ভাইদের একসঙ্গে পড়তে বসা, খাবার খেয়ে দৈত্য-দানবের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে চলে যেতাম স্বপ্নের রাজ্যে। মাঠে সবুজ ধান গাছের পাতা ছুঁয়ে আইল ধরে ছুটে যাওয়া, বাতাসে ঢেউ খেলানো সবুজ মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বুকভরে নি:শ্বাস নেওয়া কিংবা দারুণ উৎসাহে ছুটতাম ছোঁ মেরে পোকা ধরতে থাকা ফিঙ্গের পেছনে। বাড়ির দক্ষিণ দিকে জারুল, তেঁতুল, শেওড়াসহ নাম না জানা অনেক গাছ-গাছড়ার বন্যভিটায় যেন অবিভাবক হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রকাণ্ড দুই শিমুল আর শিল কড়ই । টিয়ার ঝাঁক, কাক, বাহারি রঙিন সব পাখি দলবেঁধে সন্ধ্যায় আশ্রয় নিত গাছ দুটিতে, বসন্তে উড়ে চলা শিমুল তুলার পেছনে ছুটতাম পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা, কুড়ানো তুলা দিয়ে কতরকমের পুতুল হতো । দলবেঁধে স্কুলে যেতাম পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে। কৃষ্ণচূঁড়া, কদম, কড়ই আর ঢেওয়া/ বন কাঁঠাল গাছে ছাওয়া সবুজ চত্বর স্বাগত জানাতো তার প্রিয় বিদ্যার্থীদের ।
[৯] হেডস্যারকে আমরা ভীষণ ভয় পেতাম কড়া শাসনের জন্য। অথচ স্যারের বিদায়ের দিন আমাদের সেকি কান্না! স্যারের চোখেও ছিল স্নেহের অশ্রু । ছোটবেলায় হাটবারে বাবার সঙ্গে যেতাম কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছ ঘিরে বসা হাটে, কিনতাম বাতাসা, স্যাকারিন দেয়া রসগোল্লা,নানা মিষ্টান্ন, মাটির খেলনা ইত্যাদি। হাটের মুখে থাকা কুয়ার পাড় ছিল আমাদের পাড়ার সব ছেলেদের পরিচিত স্থান। বাবা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার জায়গা। বিস্ময়ে দেখতাম কেউ কেউ ঐ কুয়া থেকে বালতি দিয়ে পানি তুলে গোসল করছে।
[১০] আজ আর কুয়াটি ব্যবহৃত হয় না। এখনও যখন ঐ কুয়ার পাশদিয়ে বাড়ি যাই, দাঁড়ালে মনে হয় বয়সের ভারে নুজ্য কুয়া বুঝি আজও অদৃশ্য হাত বুলিয়ে বলছে, বেটা ঠিক পথেই যাচ্ছ সামনে তোমার বাড়ি । গায়ের মাঝদিয়ে বয়ে চলা খাল একেবেঁকে গ্রামকে ভাগ করেছে নানা পাড়ায় । খালের উত্তরের অংশকে আমরা বলি গাঙ আর দক্ষিণের অংশকে বাইধ। বর্ষায় চারপাশে থৈ থৈ জলের মাঝে আমাদের পাড়া জেগে থাকত দ্বীপের মত ।
[১১] ভেলায় চড়ে স্কুলে যাওয়া, মাছ ধরা, দক্ষিণ পাড়ায় ফুফুদের বাড়ি যাওয়া, শাপলা-শালুক তোলা, কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফেরা সবই আজ ছবির মত ভেসে ওঠে স্মৃতির মানসপটে ।
[১৩] শীতে গারো সম্প্রদায়ের লোকজন আসত কাচাঁ মাটির রাস্তার দুপাশে ভাঁটফুল গাছের ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে গর্ত খুড়ে কচ্ছপের ডিম খুঁজতে, ডোবা সেচে মাছ ধরার সময় কুচিয়া ধরতে । তাদের ভীষণ শান্ত গোলগাল মুখ, ছোট ছোট চোখ, ফর্সাত্বক,ছোটখাট দৈহিক গড়ন, খুব সাদামাটা পোশাক সর্বোপরি আমরা সাধারণত যা খাই না সেসব খেয়ে ওদের খাদ্য মনে হতেই তাদের আর্থিক দৈন্যতা আমাদের শিশুহৃদয়কে আহত করত। পরক্ষণেই ওদের হাসিমুখ দেখে দুঃখ ভুলে পিছু পিছু ছুটতাম।
[১৪] শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে কাকার সঙ্গে খেজুরের রস সংগ্রহ করা, সবার সঙ্গে বসে পুলি পিঠা, তেলের পিঠা, ভাঁপা পিঠা খাওয়া আজও সমুজ্জল। হেমন্তে পাকা সোনারঙা ধান সূর্যের কিরণে চিকচিক করে ধাঁধিয়ে দিত আমাদের মত কিশোরদের চোখ আর হাসি ফোটাত গৃহস্তের মুখে। তখন জ্যোস্নারাতে লুকোচুরি খেলা, ধান সেদ্ধের সময় মা-চাচিদের কাছে গল্পগীত শোনা, দূরে ধান পাহাড়ারত রাখালের ভেসে আসা গান বিমোহিত করত,। গায়ের কিছু উদ্যমী যুবকের উৎসাহে-শ্রমে বৈশাখী মেলা হতো। আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষ আসতেন মেলা দেখতে। স্বরূপের সন্ধানে আয়োজিত মেলায় লোকগান, ঘুড়ি উৎসব, পালাগান দেখলেও আমাদের মত শিশুকিশোরদের চোখে বিস্ময় জাগিয়েছিল হরেক রকমের খেলনা ! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে আমাদের গ্রামেও । মানুষের জীবনমান উন্নত হয়েছে, সহজতর হয়েছে জীবনযাত্রা।
[১৫] সেইসঙ্গে শিথিল হয়েছে পারিবারিক বন্ধন, কমেছে সৌহার্দ্য । বিজলী বাতিতে জ্যোস্না হয়েছে ম্লান! যানবাহনের শব্দে ঢাকা পড়েছে পাখির কলরব। মানুষ করার কঠিন শাসনে ক্ষীণতর হয়েছে স্নেহের পরিসীমা, বাধা পড়েছে সময়।
লেখক: গবেষণা সহকারী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।