নিউজ ডেস্ক: নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে গত ৫ এপ্রিল থেকে গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার, যা আজ থেকে কিছুটা শিথিল হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে স্বল্প ও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ ছিল। নিষেধাজ্ঞা থাকায় অন্য গণপরিবহনও চলেছে তুলনামূলক কম সংখ্যায়। এপ্রিলজুড়ে রাস্তায় গণপরিবহন চলাচল থাকলেও তার তেমন প্রভাব পড়েনি সড়ক দুর্ঘটনার চিত্রে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, এপ্রিলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৫২ জন। আহতের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।
লকডাউনের মধ্যে ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হয়েছে বলে মনে করছে সংগঠনটি। অন্যদিকে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউনের মধ্যে ছোট ছোট গাড়ি নিয়ে দূরপাল্লার পথে চলাচল দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে।
লকডাউনের মধ্যে এত বেশি হওয়া সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, লকডাউনে বাস বন্ধ ছিল। এ কারণে ছোট ছোট গাড়িতে করে দূরের পথ পাড়ি দিতে দেখা গেছে মানুষকে। এমনকি মোটরসাইকেলে চেপেও অনেকেই ২০০-৩০০ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি পথ পাড়ি দিয়েছেন। মোটরসাইকেলের আর ঝুঁকিপূর্ণ হালকা যানবাহনগুলোয় দুর্ঘটনা বেশি ঘটেছে এ সময়ে। একইভাবে ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে চলাচলের কারণেও বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা।
লকডাউনের মধ্যে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে চালকদের ‘সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টর’-এর কথাও বলছেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, লকডাউনে কিন্তু সব ধরনের গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যখন কেউ রাস্তায় গাড়ি চালায়, তখন তার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করে। আতঙ্কটি মূলত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীকে নিয়ে। এ আতঙ্কের কারণে চালকদের অনমনস্ক হয়ে যাওয়া এবং তা থেকে দুর্ঘটনা ঘটাও কিন্তু অস্বাভাবিক নয়।
এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ঢাকা বিভাগে ১১২টি দুর্ঘটনায় ১৩৭ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিভাগটিতে ২০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২১ জন। আর একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ঢাকায় ২৬টি দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে পঞ্চগড় জেলায়। দুটি দুর্ঘটনা ঘটলেও সেখানে কেউ নিহত হননি।
এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪৮৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৫১৭ ও মার্চে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৩ জন মানুষের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে সংগঠনটি। এ হিসাবে মার্চের চেয়ে এপ্রিলে প্রাণহানি কমেছে ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। লকডাউনের মধ্যে সারা দেশে যাত্রীবাহী বাস বন্ধ এবং মানুষের যাতায়াত যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত, তার পরও দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির এ হারকে চরম উদ্বেগজনক হিসেবে অভিহিত করছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
লকডাউনের মাসে যেখানে বাস চলাচল পুরোপুরি বন্ধ, অন্যান্য গণপরিবহনের চলাচলও তুলনামূলক কম ছিল। তার পরও এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা কেন হচ্ছে, জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, লকডাউনের কারণে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো তুলনামূলক ফাঁকা ছিল। আর ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়াভাবে ব্যক্তিগত যানবাহনসহ বিভিন্ন গাড়ি চলাচল করেছে। বেপরোয়া চলাচলের কারণেই দুর্ঘটনা বেশি হয়েছে। অন্যদিকে আমাদের পরিসংখ্যান বলছে, এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে ট্রাক ও মোটরসাইকেল। সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ট্রাক ও মোটরসাইকেল চরম হুমকি হয়ে উঠেছে। গত মার্চের তুলনায় এপ্রিলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। মোটরসাইকেল কেনা ও চালানোর ক্ষেত্রে নিয়মিত নজরদারি ও ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে না পারলে দুর্ঘটনার চিত্র আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে বলে মনে করেন তিনি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, এপ্রিলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৮ জন নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ৩৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৯৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২১ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর যানবাহনের চালক ও চালকের সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৩ জন। দুর্ঘটনা রোধে দক্ষ চালক তৈরি, চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করে দেয়া, ট্রাফিক আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ, সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নসহ বেশকিছু সুপারিশ করেছে সংগঠনটি।
সড়কের পাশাপাশি লকডাউনের মাসে নৌ ও রেলপথেও একাধিক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এপ্রিলে নয়টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৪২ জন নিহত এবং ১১ জন আহত হয়েছেন। চারজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর রেলপথে সাতটি দুর্ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। - বণিক বার্তা