সুমন্ত আসলাম: বাবা ঠিক এইসব দিনে, রোজার এই কয়দিনে, মাকে কাছে ডেকে বলতেন, ‘এবারের ঈদে কাউকে কিছু দিতে পারবো না।’ আমার সনাতনী মা তার ঘোমটাটা আরও একটু টেনে নিতেন, ‘সমস্যা নেই। ওদের বুঝায়া বলমু আমি।’ মা আমাদের কিছু বলতো না, কিন্তু আমরা ছোট পাঁচ ভাই বোন একে একে জেনে যেতাম সবকিছু। বিরহ-বদনে আমরা সারা বাড়ি হাঁটতাম, যেন আমরা হাঁটছি না, আমাদের ছায়া হাঁটছে। সংসারে অভাব ছিলো আমাদের। খাবার আর লেখাপড়ার পর কিছু কিছু জমাতেন বাবা, খুবই সামান্য। সেই জমানো টাকা থেকে ঈদের দুদিন আগে কিছু কিনতে দিতেন আমাদের, সবার জন্য। বাবা কখনো মায়ের হাত ধরেছেন কিনা চোখে পড়েনি আমাদের; ভালোবাসাময় কোনো কথোপকথন হয়েছে কিনা, সেটাও অকস্মাৎ কানে আসেনি আমাদের।
মা ভয় করত বাবাকে, আমরা তার ছায়া দেখলে পালাতাম। কিন্তু একটা জিনিস চোখ এড়াতো না আমাদের। দুপুরের পর মা যখন সংসারের সব কাজ সেরে, গোসল করে, ঈদের তাতের নতুন শাড়িটি পরতো, তারপর বাবার সামনে যেতো, বাবা একপলক মাকে দেখতেন, আমরা দূর থেকে তাদের দেখতাম। স্পষ্ট দূরের আমার ফর্সা মাকে তখন কেমন লাল দেখাতো, মুখে দ্যুতি, ঠোঁটে লাজুকতা। বাবা কি নতুন শাড়ীতে মাকে কিছু বলতেন- তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে কিংবা আই লাভ ইউ জাতীয় কিছু? আমি এবং আমার ভাই-বোনেরা নিশ্চিত ছিলাম- বাবা এরকম কিছু বলেননি। সংসারের নিত্য অভাবের আধিক্যতায় কেবল একখণ্ড তাকিয়েছিলেন বাবা, আর বাবার চোখে মা দেখেছিলেন মিহিদানার প্রশ্রয়, নরম জ্যোতি, অথবা অন্তর্গত ভালোবাসার বিনিময় হয়েছিলো চোখ আর চোখে।
তারপর বাকী দিন মার কী প্রফুল্লতা, হাঁটায় হরিণের চঞ্চলতা, ময়ুরের পেখম মেলানো ছন্দ। সাঁইত্রিশ বছর সংসার করেছেন তারা- অভাব আর দুখের প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে যে ফুলকি বেরুতো প্রতিদিন, সেই আলোতে সুখ ছিলো, শ্রদ্ধা ছিলো, পরস্পরের প্রতি সম্মান ছিলো, ছিলো অব্যক্ত এক ভালোবাসা। সব মাখামাখিতে বাবা হয়েছিলেন গর্বিত, মা হয়েছিলো নিবেদিত। বিল স্যার, মেলিন্ডা ম্যাডাম, আপনারা কি আমার বাবা-মাকে চেনেন? ওপারের পৃথিবীতে একদিন পরিচয় করিয়ে দেবো আপনাদের। দেখবেন আলোর মতো সরল পথে চলা মানুষগুলোও কতো সরল, আলোময়। জগতের ধন-সম্পদ সেখানে তুচ্ছ, নিতান্তই অপাংক্তেয়! ফেসবুক থেকে