কালের কণ্ঠ: ১৬ বছর আগে নিষিদ্ধ করা হয়েছে জঙ্গি সংগঠনটিকে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় তাদের বেশির ভাগ সদস্যও কারাগারে। এর পরও বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার নেপথ্যে থাকা হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) তৎপরতা থেমে নেই। সম্প্রতি বান্দরবানের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় সন্ধান পাওয়া গেছে তাদের প্রশিক্ষণশিবিরের। ইজারা নেওয়া জমিতে মাদরাসা স্থাপন করে এর আড়ালে চলছিল জঙ্গি কার্যক্রম।
ওই মাদরাসা থেকে ২৪ শিশুকে উদ্ধারের পর প্রাথমিক তদন্ত শেষে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। উদ্ধার সব শিশুকে তাদের অভিভাবকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ি এলাকার অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের এসব শিশুকে টাকা-পয়সার বিনিময়ে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল বলেও তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানতে পেরেছেন।
গত ৪ মার্চ রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকা থেকে হুজির অপারেশন শাখার প্রধান মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিনসহ তিন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। তাদের দুই দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে পাহাড়ে মাদরাসার আড়ালে হুজির প্রশিক্ষণশিবিরের অস্তিত্ব ও জঙ্গি কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। পরে অভিযান চালিয়ে শিশুদের উদ্ধার করা হয়। জঙ্গিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, প্রশিক্ষণশিবির গড়ে তোলার পাশাপাশি সংগ্রহ করা হচ্ছে আধুনিক অস্ত্র ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম। নানাভাবে অর্থের জোগান নিশ্চিত করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে কারাগারে থাকা সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের জামিনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
প্রস্তুত করা হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ শুরা কমিটি। এরই মধ্যে জঙ্গিদের দেওয়া এসব তথ্য খতিয়ে দেখা শুরু করেছেন গোয়েন্দারা।
সিটিটিসি সূত্রমতে, হুজি নেতা মাইনুল ইসলাম একাধিক ছদ্মনামে, কখনো মাহিন, মিঠু বা হাসান নামে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাতেন। তিনি ‘সাংবাদিক’ পরিচয়ে মাদরাসার জন্য জমি ইজারা নিয়েছিলেন বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানতে পেরেছেন। মাইনুল ২০১৬ সালে হুজির শীর্ষ নেতা কারাবন্দি মুফতি মঈনউদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তবে জেল থেকে বেরিয়ে আবার হুজির কার্যক্রমে জড়ায়। মাইনুলকে যিনি সাংবাদিক পরিচয়পত্র দিয়েছিলেন তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সিটিটিসি সূত্র জানিয়েছে, মাদরাসার কয়েকটি নথি থেকে ৪০ জনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন সম্প্রতি হুজিতে যোগ দিয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই মাদরাসায় তহবিল দিয়েছেন। তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য নেই। পাহাড়ে তারা দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছে। সিটিটিসির অভিযানের আগেই তারা গা-ঢাকা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের শীর্ষ মহলকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে।
এর আগে গত পাঁচ-ছয় মাসে গ্রেপ্তার আরো কয়েকজন জঙ্গি সদস্যের কাছ থেকেও জিজ্ঞাসাবাদে প্রায় একই ধরনের তথ্য পান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ অবস্থায় ছদ্মবেশে সক্রিয় হুজিকে নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
অপরাধবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু একক সংগঠন হিসেবে হুজি নয়, জঙ্গিবাদ এখনো দেশের জন্য বড় সমস্যা। এর শেকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে। তাঁরা বলছেন, আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়ে জঙ্গি সদস্যদের ডি-র্যাডিক্যালাইজেশনের আওতায় আনা হচ্ছে বটে, তবে এটা স্থায়ী সমাধান নয়। জঙ্গি সংগঠনগুলোর কোমর ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ তাঁদের।
গ্রেপ্তার মাইনুল জানিয়েছেন, নতুন সদস্য সংগ্রহ করতে দাওয়াতি কর্মকাণ্ড বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি অর্থ সংগ্রহ, বোমা তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ করে আসছিলেন তিনি। তাঁর পরিকল্পনা ছিল ঢাকা শহরে বড় ধরনের নাশকতা চালিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা।
মাইনুলের সঙ্গে গ্রেপ্তার অন্য দুজন হলেন, শেখ সোহান সাদ ওরফে বড় আব্দুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবির। এই তিনজনের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়েছে। দুই দফা রিমান্ড শেষে তারা এখন কারাগারে। সোহান সাদও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ২০১৬ সালে। জামিনে মুক্ত হয়ে ফের জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েন তাঁরা।
জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা সিটিটিসিকে জানিয়েছেন, কারাগারে আটক ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর এবং ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মেহেদী হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে গাজী খানের নির্দেশে সাংগঠনিক কাজ করছিলেন তাঁরা। কারাবন্দি নেতাদের সঙ্গে তাঁরা কিভাবে যোগাযোগ রাখতেন—এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা সিটিটিসিকে জানিয়েছেন, কারাগারেও তাঁদের লোক আছে।
জানতে চাইলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনার পর অনেক তরুণের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এরপর টানা অভিযানে জঙ্গিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়। তবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমে যাওয়ায় অনেকেই মনে করছে, বিপদ কেটে গেছে; কিন্তু কাটেনি। সম্প্রতি এর মধ্যেই পুলিশকে লক্ষ্য করে কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই হামলার সঙ্গে জঙ্গি সদস্যরা জড়িত বলে জানান তিনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রও জানিয়েছে, নিষিদ্ধ করার পরও হুজির কার্যক্রম থেমে নেই।
হুজির নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার বিষয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বন্দি আসামিদের সঙ্গে গ্রেপ্তার মাইনুলের যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। হুজি ছদ্মবেশে সারা দেশে সক্রিয় রয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গি সদস্যরা সিটিটিসিকে জানিয়েছে, বর্তমান রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থাকে ‘তাগুদি’ মনে করে তারা। এ জন্য পরিস্থিতির পরিবর্তন চায় তারা। একটি বিশেষ ইসলামী রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে তারা। নিজেরাও চাঁদা তুলে অর্থের জোগান ঠিক রাখছে। নিয়মিত গোপন বৈঠক করে তারা। তবে এক জায়গায় একবারের বেশি বৈঠক করা হয় না।
হুজির কর্মকাণ্ড অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন থেকে কিছুটা আলাদা জানিয়ে এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, হুজির মাধ্যমে দেশে জঙ্গি তৎপরতার শুরু। একটা সময় তারা অনেকটা প্রকাশ্যেই কর্মকাণ্ড চালাত। আফগান যুদ্ধ চলাকালে ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে সদস্য সংগ্রহ করতে ব্যানার টানিয়েছিল। সে সময় সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতা পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদরাসায় লেখাপড়া করেছিলেন। তাঁরা গেরিলাযুদ্ধ ও ভারী অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সংগঠনের শুরুতে দেশের দেওবন্দ ধারার কওমি মাদরাসার ছাত্রদের সংগঠনে ভেড়াতেন তাঁরা। মূলত ১৯৯২ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত হুজির বিস্তার ছিল ব্যাপক।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) বলেন, শুধু হুজি নয়, জঙ্গিবাদ এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। অনেক জঙ্গি সদস্যকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়ে ডি-র্যাডিক্যালাইজেশনের আওতায় আনা হচ্ছে, তবে এটাই স্থায়ী সমাধান নয়। অবশ্যই উগ্র মৌলবাদ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, তা না হলে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও তারা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে নানা বেশে সক্রিয় থাকা উগ্র মৌলবাদীরা সব সময়ই মাথাব্যথার কারণ মন্তব্য করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, এখনো হুজির যারা গ্রেপ্তার হয়নি, অর্থাৎ ঘাপটি মেরে থাকা এই জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করতে হবে। নইলে সুযোগ পেলেই এরা ছোবল মারবে। একই সঙ্গে উগ্র মৌলবাদের অর্থনীতির দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এদের অর্থের জোগান বন্ধ করতে হবে বলে মত দেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালের অক্টোবরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় হুজিকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় হুজি সদস্যদের ব্যাপক ধরপাকড়। এতে প্রথম প্রজন্মের এই জঙ্গি সংগঠন অনেকটাই নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে।