শিরোনাম
◈ সরকারি দপ্তরগুলোতে গাড়ি কেনা ও বিদেশ সফরে কড়াকড়ি: কৃচ্ছ্রনীতির অংশ হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা ◈ ২১ বছর বয়স হলেই স্টার্ট-আপ লোনের সুযোগ, সুদ মাত্র ৪%: বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা ◈ ঢাকায় একটি চায়না টাউন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে: আশিক চৌধুরী ◈ তিন বোর্ডে বৃহস্পতিবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত ◈ এসএসসির ফল নিয়ে যে বার্তা দিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা ◈ সৈক‌তের কা‌ছে দু:খ প্রকাশ ক‌রে‌ছেন ‌বি‌সি‌বির প্রধান নির্বাচক  ◈ ভারত সরকারকে আম উপহার পাঠাল বাংলাদেশ ◈ পুলিশের ঊর্ধ্বতন ১৬ কর্মকর্তা বদলি ◈ কল রেকর্ড ট্রেলার মাত্র, অনেক কিছু এখনো বাকি, অপেক্ষায় থাকুন: তাজুল ইসলাম ◈ জাতীয় নির্বাচনের সব প্রস্তুতি ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা : প্রেস সচিব

প্রকাশিত : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১০:৩০ দুপুর
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১০:৩০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ড. আতিউর রহমান: সাধারণ মানুষকে ধারণা দেওয়া হয়েছিলো, বাংলা ভাষার দাবি তুললে ইসলাম ধর্ম থাকবে না!

ড. আতিউর রহমান: ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করেছিলো এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই বঙ্গবন্ধুসহ বেশকিছু রাজনৈতিক নেতা বাংলা ভাষার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন। সেই বিবৃতিতে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার দাবি ছিলো। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে এসে তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে অনুভব করলেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের কথা তারা ভেবেছিলেন তা হয়নি। অর্থাৎ যে আশাবাদ নিয়ে তারা পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলন করেছিলেন সে পাকিস্তান হয়নি। কারণ পাকিস্তান চলে গিয়েছিলো সুবিধাবাদী এলিটদের হাতে, সেখানে শাসনকার্যে বাঙালির অংশগ্রহণ ছিলো সামান্য।

পূর্ব-পাকিস্তানকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুসহ তার বন্ধুরা পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তারা আশা করেছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠবে। যারা একসময় প্রজা ছিলো বা অন্যর জমিতে কাজ করতো তারা জমির মালিক হবে। তাদের ধারণা ছিলো-এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভ‚মি, রাজনীতি, প্রশাসন ও অর্থনৈতিক বিকাশে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে তারা নিজেদের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারবে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ঢাকা ফিরে এসে দেখলেন পাকিস্তান চলছে ঠিক উল্টো পথে। আস্তে আস্তে সুবিধাবাদী রাজনীতি দানা  বেধে উঠছে।

রাজনীতি চলে গেছে আমলা, মহাজন, প্রশাসনের হাতে। পাকিস্তান সরকার মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও কৃষকের আশা-আকাক্সক্ষা উপেক্ষা করতে থাকলো। তাই ভাষা আন্দোলনের পেছনে একটি আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা ছিলো। যখন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু হলো তখনই বাঙালি তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনে ফেটে পড়লো। ভাষার ওপর যখন আঘাত এলো তখন বাঙালিরা চ‚ড়ান্তভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আন্দোলনের সূতিকাগার ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র ও শিক্ষকরাই প্রথম দিকে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন এবং নেতৃত্ব পর্যায়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। বঙ্গবন্ধু যখন দেখলেন মুসলিম লীগ বাঙালির অধিকার আদায়ে একেবারেই উদাসীন তখন তিনিসহ ছাত্ররা একটা নতুন ছাত্র সংগঠন তৈরি করলো।

ফজলুল হক হলে তারা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করলেন। তরুণ কর্মীদের মধ্যে পাকিস্তান নিয়ে বিরাজমান হতাশা দূর করার জন্য তারা এ ছাত্র সংগঠন গড়লেন। তমদ্দুন মজলিস অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে মিলেমিশে এই ছাত্র সংগঠনটি ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তখনকার সময় গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামেও বঙ্গবন্ধু একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণ সমাজ কী ভাবতো এবং তরুণ সমাজ কীভাবে আশাহত হয়েছিলো, তা পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘোষণাপত্রে তারা বলেন, ‘আমরা মধ্যবিত্ত যুব সমাজ স্বপ্ন দেখেছিলাম পাকিস্তানে আমরা চাকরি পাইবো, ব্যবসা-বাণিজ্যর সুযোগ পাইবো, গৃহ পাইবো, উন্নত সংস্কৃতি ও জীবন ধারণের মান পাইবো। বাস্তবতার নিষ্ঠুর আঘাতে সে স্বপ্ন আমাদের ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। অভাবের কারণে আমরা জর্জরিত।’

এরকম সমস্যার কারণে বাঙালি যখন বিক্ষুব্ধ ঠিক তখনই এলো ভাষার ওপর আঘাত। বঙ্গবন্ধু নিজেও তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের কথা বলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে জিন্নাহ যখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, একমাত্র উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, তখন ছাত্ররা সঙ্গে সঙ্গে এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলো এবং কিছুক্ষণের জন্য জিন্নাহ বক্তব্য বন্ধ রেখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে জিন্নাহ যতোদিন বেঁচে ছিলেন, কোনোদিন বলেননি উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো অংশগ্রহণ ছিলো না। কারণ তাদের বিভিন্নভাবে ধারণা দেওয়া হয়েছিলো, বাংলা ভাষার দাবি তুললে ইসলাম ধর্ম থাকবে না! এ বিষয়গুলো উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কাজ করা শুরু করলেন। তিনি ঢাকার বাহিরে মহফস্বল শহর ও গ্রাম-গঞ্জে আন্দোলন ছড়িয়ে দিলেন। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও কৃষকদের নিয়ে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করলেন। একসময় বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সঙ্গে একাত্বতা জানিয়ে আন্দোলনে যোগ দিলে তাকে আইন বিভাগ থেকে বহিষ্কার করে গ্রেপ্তার করা হয়। জেল থেকে বের হয়ে এসে তিনি আবার মূল ধারার রাজনীতি শুরু করলেন। আওয়ামী লীগ করবার জন্য যে ধরনের রাজনীতি করা দরকার তিনি সেভাবে শুরু করলেন। সে আন্দোলন করতে গিয়ে তাকে আবার জেলে নেওয়া হলো। ভাষা আন্দোলন চলার সময় বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন।

অসুস্থতার কারণে তাকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। মেডিকেলে থাকা অবস্থায় তিনি ভাষা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। রাতে সব দলের ছাত্র নেতারা তার কাছে আসতেন। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু ছাত্রনেতাদের বললেন, ২১ ফেব্রুয়ারি তোমারা ঢাকায় মিছিল করো এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে আমি অনশন করবো। এটা জানার পর পাকিস্তান সরকার তাকে মেডিকেল থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে উঠিয়ে নিয়ে গেলো। তারপর তাকে নেওয়া হয় ফরিদপুরের জেলে। সেখানে তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে পূর্ব ঘোষিত অনশন ধর্মঘট শুর করলেন, যা মুহূর্তেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো।

২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ অনেকই হত্যা করলো। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। শেখ মুজিবসহ যেসব মধ্যবিত্ত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলো, তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি পিতা শহরে বাস করতেন, ৭০ শতাংশের বেশি পিতা ৫ একরের বেশি জমির মালিক ছিলেন, ৬৮ শতাংশ আন্দোলনকারী কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার মানে নেতৃত্বে থাকা মধ্যবিত্তের সঙ্গে গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটি গভীর সংযোগ ছিলো। সেটা পরবর্তীকালে আন্দোলনের সাফল্যে দেখতে পেরেছি।

একপর্যায়ে পুরান ঢাকার সরদারেরাও আন্দোলনের পক্ষ অবলম্বন করলো। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলো এই আন্দোলন ন্যায়সঙ্গত। এমনকি দোকান মালিকরা তাদের কর্মচারীদেরও আন্দোলনে যেতে দিতেন। এভাবে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে তৎকালীন পূর্ববাংলার মানুষের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

পরিচিতি : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক। অনুলেখক : শাহীন হাওলাদার

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়